বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

কেন বার বার লঞ্চ দুর্ঘটনা

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নৌ-নিরাপত্তা নিয়ে কারো কোন উদ্বেগ নেই। একের পর এক শোচনীয় লঞ্চ দুর্ঘটনায় মায়ের বুক খালি হচ্ছে। স্ত্রী হারাচ্ছে পিতাকে, ভাই হারাচ্ছে বোনকে। ডাকঢোল পিটিয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ে ‘নৗ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্প’ ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়নি। একটি দুর্ঘটনা ঘটলেই নৌ-মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসন জেগে উঠে। মিটিং মিছিল হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারপর
কিছুদিন চলে গেলেই আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এ ব্যাপারে তাদের আর কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রত্যেকটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পর নৌ- পরিবহন মন্ত্রী ত্রুটিপূর্ণ নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু বাস্তবে এ হুশিয়ারি উচ্চারণ কর্তৃপক্ষের কানে প্রবেশ করে না। ফলে বার বার লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মালিক ও চালকদের গাফিলতির কারণে প্রতি বছর বেশ কয়েকটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত লোকের করুণ মৃত্যু আমাদেরকে অসহায়দের মত চেয়ে দেখতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নৌযান চালনার নির্ধারিত নীতিমালা মেনে না চলাই এসব ট্রাজেডির মূল কারণ।
গত ১৫ মে রোববার পটুয়াখী জেলার গলাচিপার উপজেলার চরকাজল এলাকার বুড়া গৌরঙ্গ নদীতে বেলা ১১টায় দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ‘প্রিন্স অব পটুয়াখালী’ নামের লঞ্চটি ডুবে যায়। ভোর পাঁচটায় পটুয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল থেকে চরমন্তোজের উদ্দশ্যে ছেড়ে যায় এ লঞ্চটি। চরকাজল ঘাট থেকে ৫০০ গজ দূরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে লঞ্চটি বুড়া গৌরাঙ্গ নদীতে ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। বেশ কিছু যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ যাত্রীর করুণ মৃত্যু ঘটে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানান, লঞ্চটিতে জীবন রক্ষার কোন সরঞ্জামাদি ছিল না। উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামলা এসে অবশেষে লঞ্চটি ও ৮৪টি লাশ উদ্ধার করে। আরো অসংখ্য লাশ নদীতে ভেসে গেছে। জানা গেছে এ লঞ্চটি এর আগেও ৩ বার দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ডুবে যায়। বর্তমানে এবছর এটি চতুর্থ বারের মতো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নদীতে তলিয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯৮২ সালে এই লঞ্চটি নির্মাণের পর ১৯৮৯ সালে এটি পটুয়াখালী সদর উপজেলার লোহালিয়া নদীতে ডুবে যায়। তারপর ১৯৯৬ সালে এটি মির্জাগঞ্জ উপজেলার পায়রা নদীতে এবং একই বছরে পটুয়াখালী লঞ্চ টার্মিনালের কাছে নিমজ্জিত হয়।
প্রতি বছরই লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর এটিকে উদ্ধারকারী জাহাজের মাধ্যমে উদ্ধার করে কোন প্রকার সংস্কার ছাড়াই বিভিন্ন রুটে চালানো হয়। এই ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি কিভাবে নৌযান রুট পারমিট পেয়ে চলাচল করছিল এ প্রশ্নের জবাব নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়েল কর্মকর্তারা দেবেন কি?
‘প্রিন্স অব পটুয়াখালী’ ডুবার মাত্র দু’দিন মাথায় গত ১৭ মে মঙ্গলবার এমভি রায়পুরা লঞ্চটি নটাখোলা থেকে আরিচার পথে ছেড়ে আসা যমুনার অশ্বয়পুর নামক স্থানে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে বিকেল ৪টায় ডুবে যায়। এটিও অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে ডুবে যায়। উদ্ধারকারী জাহাজ ‘রুস্তম’ টানা ছয়দিন চেষ্টা করে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। ছয়দিদেনর চেষ্টায় মাত্র ৫৫টি লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আরো শত শত লাশ লঞ্চের ভেতরে রয়েছে বলে ডুবুরিরা জানান। লাশের ওজন ও লঞ্চের ভেতরে পলি জমে যাওয়ায় উদ্ধারকারী জাহাজ ‘রুস্তমের’ পক্ষে লঞ্চটি টেনে তোলা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আরিচায় নিমজ্জিত একটি লঞ্চ উদ্ধার হয়নি। এসব ছোট লঞ্চগুলোকে উদ্ধার না করার কারণ হিসেবে দেখা যায় উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। তখন বলা হয় ২৫ বছর পর তা অকেজো হয়ে যাবে। সেই মোতাবেক ১৯৮৮ সালেই তা বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর যাবত এই অকেজো জাহাজ দিয়েই উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে। অপরদিকে ‘রুস্তম’ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। তাও পাঁচ বছর পূবেই অকেজো হয়ে গেছে। তাছাড়া বর্তমানে নৌ- পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিআইডব্লিউটিএ‘র কাছে মাত্র ৪ জন ডুবুরি রয়েছে। ৪ জন ডুবুরির মাধ্যমে সারাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার উদ্ধার কাজ চলে। আর এই অকেজো উদ্ধারকারী জাহাজ দুটো দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সময় লাগে ৩২ ঘন্টা। তাই অচিরেই নতুন জাহাজ কেনার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
এমভি রায়পুরা ডুবার আরো দুদিন পর গত ১৯ মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালুর কাছে মেঘনায় ঝড়ের কবলে পড়ে যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে যায়। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ৭০ মন মালামাল ও যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু থেকে তজুমদ্দিন উপজেলার চরজহিরউদ্দীন অভিমুখে রওয়ানা হয়। ট্রলারটি মির্জাকালু থেকে ছেড়ে আসার কিছুক্ষণ পরে ডুবে যায়। এই ট্রলারটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ছোট বড় অসংখ্য নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে অথচ এ ব্যাপারে সরকার কোন পদক্ষেই নিচ্ছে না।
জানা গেছে এমভি রায়পুরা এক ধরনের অভিশপ্ত লঞ্চ। এই ৫টি লঞ্চের মধ্যে ৪টি লঞ্চই এ পর্যন্ত ডুবে গেছে। বেঙ্গল ওয়াটার কোম্পানির মালিক শামসুল ইসলাম দুদু মিয়ার মেয়ে মরহুম রাজিয়া বেগম ৩টি লঞ্চ পৈতৃক ওয়ারিশ সূত্রে পেয়ে মালিক হন। তার স্বামী গাজী ফিরোজুল ইসলাম ১টি ও ছেলে গাজী ফারুক একটি নির্মাণ করেন। লঞ্চগুলোর নাম এমভি রায়পুরা, লালারুক, শিরিন, নাবিল ও গাজী ফারুক। ৩টি পদ্মা যমুনায় ও একটি বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রীসহ ডুবে যায়। এমভি রায়পুরা ১৯৬১ সালে তৈরির বছর তিনেক আগে লঞ্চটি কাঠবডি থেকে স্টীল বডিতে রুপান্তর করা হয়। এই কোম্পানীর নাবিল নামের লঞ্চটি অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। (সূত্র-২১ মে ২০০৫, ইনকিলাব)
বিশেষজ্ঞরা অনুসন্ধান করে দেখেছে ৫ কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে।
১.    নৌযানের কাঠামোগত ও কারিগরি ত্রুটি ও দুর্বল।
২.    নৌযান চালনার দুর্বলতা ও ত্রুটি।
৩.    নৌযানের স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী পদ্ধতিতে যাত্রী ও মাল বোঝাই।
৪.    ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই।
৫.    ঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এ প্রসঙ্গে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী আকবর হোসেন বলেছেন, পাঁচ বিষয়ের মধ্যে প্রায় সবগুলো নৌযান পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সাথে সর্ম্পকযুক্ত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কেবলমাত্র আকস্মিক প্রাকৃতিক দুযোর্গ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। (নয়া দিগন্ত, ১৯ মে ২০০৫)
বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান নৌ-দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়ার প্রয়োজন যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে। আর উপরোক্ত কারণগুলো সনাক্ত করে নৌদুর্ঘটনা রোধে যাতে কার্যকরি পদক্ষেপ নেন। কারণ জাতি আর এ ধরনের অনাকাংখিত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চোখের পানি ফেলতে চায় না। 

প্রকাশকাল: বুধবার, ১ জুন ২০০৫ইং

কোন মন্তব্য নেই: