বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০১৫

কাশফুল


আকাশে শরতের সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে শরতের সাদা মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আকাশের দিকে তাকাতে পারছি না। উপরে আকাশ নিচে নদী মাঝখানে আমি ও রফিক। তিতাস নদীর দুপাশে কাশফুল। খুব ভালই লাগছে। আমি আর রফিক কাশফুল দেখার উদ্দেশ্যে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি সেই বিকাল বেলা। 
ধরাভাঙ্গা গ্রামের পাশেই তিতাস নদী। নদীর পাড়ে সারি সারি কাশফুল ফুটে আছে। এটি বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতো নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শেষ সীমানায় এই গ্রামটি অবস্থিত। উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগে নি। এ গ্রামের মানুষগুলো খুবই সাধা-সিধে, সহজ-সরল। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসে। বিপদ আপদে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর বিপক্ষে ঝাপিয়ে পড়ে। এক বাড়িতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হলে সবাই মিলেমিশে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করে। এই গ্রাম থেকে সলিমগঞ্জ বাজারে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি ভাঙাচোরা। এই রাস্তায় প্রতিদিন শত শত মানুষ কষ্ট করে দেড় কিলোমিটার দূরে সলিম গঞ্জ বাজারে গিয়ে বাজার সদাই করে। এই গ্রামের দক্ষিণ পাশে মস্ত বড় এক বিল। বিলের এক পাশে রফিকদের গ্রাম ধরাভাঙ্গা আর অন্যপাশে আছে মুক্তারামপুর গ্রাম। দুই গ্রামের মাঝখানে এই বিলের অবস্থান। সেই বিলে বর্ষাকালে এক সময় মাছ চাষ করা হতো। আর শীতকালে যখন সেই বিল শুকিয়ে যেত তখন সেখানে বোরো ও এনাম ধান লাগাতো কৃষকরা। 
কোরবানীর ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসছে রফিক। বাড়িতে এসে দেখে সেই বিলের চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে। এমন চেহারা রফিক আর কোন দিন দেখেনি। হঠাৎ করে বিলের দিকে নজর দিতেই রফিক দেখল সমস্ত বিল কচুরী পানায় ভরে গেছে। মনে হয় যেন কচুরী পানার চাষ করা হচ্ছে। সবগুলো কচুরী পানায় ফুল ফুটেছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। বিলের আশে পাশে ও তিতাস নদীর দুধারে কাশফুল ফুটেছে। এ দৃশ্য দেখার জন্য রফিক আমাকে ঈদ উপলক্ষে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করল। আমিও কাশফুল, কচুরী পানা, নদী, গ্রাম এগুলো কখনো দেখিনি। তাই এসব দেখার জন্য রফিকের আমন্ত্রণে আর দেরি না করে ঈদের পরদিন চলে আসলাম তাদের গ্রামে।  
রফিক বিকাল বেলায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেড় হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য প্রথমে কচুরীপানা দেখব এবং পরে নৌকায় করে কাশফুল ও প্রকৃতি উপভোগ করব। আমিতো এমন সুন্দর পরিবেশ দেখে অবাক। কচুরী পানার ফুল দেখে লোভ সামলাতে না পেরে সাথে থাকা ক্যামেরায় বন্ধি করি সেই চমৎকার ছবিগুলো। বিলের শেষ প্রান্তে আছে ব্রিজ। সেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে পুরো বিলের ছবিটি উঠালাম। 
কচুরীপানা দেখার পর নৌকায় তিতাস নদীতে গিয়ে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। এই প্রথম আমি নৌকাতে উঠলাম। কারণ শৈশব কেটেছে আমার শহরে। গ্রামে আমার কেউ নেই বলে কোনদিন গ্রামে আসা হয়নি। আর নদী, কাশফুল এগুলোতো চোখেই দেখিনি। নৌকা ছুটছে নদীর পাড় ঘেষে। রফিক নিজে মাঝি সেজে নৌকা চালাচ্ছে। নৌকা ছুটছে স্রোতের টানে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। শরতের আকাশ খুব সুন্দর। শরতের সাদা সাদা মেঘ এবার স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে। বেশ ভালই লাগছে। 
ধরাভাঙ্গা গ্রামের উত্তর পাশেই রয়েছে বিশাল একটি চর। আমরা লক্ষ্য করলাম সেই চরে অসংখ্য কাশফুল ফুটেছে। সেই দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ও ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে আমি রফিককে বললাম তাড়াতাড়ি নৌকা ঐ চরে নেয়ার জন্য। নৌকা ওপারে এসে থামল। আমরা চরে নেমে পড়লাম। একটু সামনে গিয়ে দেখি কাশফুলে ছেয়ে গেলে পুরো চর। 
কাশফুল দেখে আমি আকাশ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দিত হলাম। এ রকম আনন্দ জীবনে খুব কমই এসেছে। চারদিকে কাশফুল। যেন কাশফুলের বাগান। যেদিকে তাকাই শুধু কাশফুল আর কাশফুল। উপরে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর নিচে এই কাশফুলের বাগান। শরতের যেন অপূর্ব সৃষ্টি। এ দৃশ্য প্রচন্ড ভালো লাগছে আমার। রফিককে ধন্যবাদ দিতে হয় এ রকম পরিবেশে নিয়ে আসার জন্য। কাশফুলের মাঝ দিয়ে হেঁটে চললাম আমরা। ফুলের এলাকা যেন শেষ হচ্ছে না। আশে পাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে প্রেমালোচনায় মগ্ন। ওদের যেন ডিস্টাব না হয় সেই ভেবে আমরা অন্যদিক দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। 
কাশফুলের সাথে নদীর একটি সর্ম্পক আছে। তাইতো বেশিরভাগ কাশফুল নদীর তীরেই ফুটে। সাদা সাদা মেঘের মতো বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এ দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এমন চমৎকার নয়নাভিরাম দৃশ্য আর কোনদিন দেখিনি। যেখানে তাকাই শুধু সাদা মেঘের মতো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুল। 
কথিত আছে, নদীর তীরে যে সারি সারি কাশফুল দেখা যায় তা একদা এক অপসরার কেশের মতো ঘনকালো দীঘল ছিল। অপসরার হলো শরৎ ঋতু পরিচালিকা সুরকেশী। শরৎ কাল এলে এই অপসরা স্বর্গ থেকে তার দীঘল ঘনকালো কেশগুলো ছড়িয়ে দিতো কাশফুলের রূপে। কেশগুলো ছড়িয়ে নদীর শারদীয় বাতাস ও রোদে শুকাতো। শারদীয় বাতাসে কাশফুলে একটা নরম সুরের মূর্ছনা উঠতো। রাতেরবেলা সেই সুরের মোহে নদীকূলকর্তী যুবক ও যুবতীরা ছুটে আসতো, প্রণয়ে মত্ত হতো। সেই কথা অনেক আগেই আমি বইয়ে পড়েছি। আজ তা সরাসরি দেখে মুগ্ধ হলাম।
আমি লক্ষ্য করলাম চারিদিকে ঘন কালো দীঘল কাশফুল বাতাসে ঢেউ খেলছে। ঋতু পরিবর্তনের চক্রে সুরকেশী এবার যেন দ্রুত পদক্ষেপেই ধরায় এসেছে। তিতাস নদীর দুই তীর যেন এক অপার বিস্ময়ের রূপ ধারণ করেছে। নদী তীরের বৃক্ষরাজীগুলো ভিন্ন সৌন্দর্যে শোভিত হয়েছে। আমি আরো লক্ষ্য করে দেখলাম নানান পাখি এ গাছ ও গাছে গান গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতিরা ডানা মেলে ওড়ছে। 
অনেকক্ষণ ধরাভাঙ্গার চরে বেড়ালাম। যতই ঘুরছি ততই ভাল লাগল। এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রক্তিম সূর্যটা টুপ করে আমাদের সামনে ডুবে গেল। সন্ধ্যা হতে না হতেই কাশফুলগুলো যেন বীনের বাজনা শুরু করে দিল। হালকা বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এবার বিদায়ের পালা। আর এখানে থাকা যাবে না। তাই দুই বন্ধু চলে আসলাম।
রফিকদের গ্রামের পূর্ব পাশে এমপি টিলা খ্যাত একটি স্থান আছে। সেখানে ইদানিং একটি ইটখোলা তৈরি করা হয়। এর পাশেই মেঘনা নদী। সেই ইটখোলা ও এমপি টিলা দেখার জন্য আমরা সেখানে যাই। এই এমপি টিলাটি তৈরির পেছনে একটি ছোট ইতিহাস আছে। এ গ্রামের সাবেক প্রয়াত এমপি ছিল আঃ লতিফ। তিনি নদী ভাঙ্গন রোধ করার জন্য মাটি দিয়ে নদীর পাড় অনেক উঁচু করে দেন এবং এর চারপাশে সিমেন্টের পাটা দেন। এর ফলে নদী ভাঙ্গন রোধ হয়। এই পাড়ে এখন বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়। এটা এখন দূর থেকে দেখলে পার্কের মতো মনে হয়। তাই এলাকার মানুষ এই জায়গাটার নাম এমপি টিলা রাখে এবং এই নামেই সবাই ডাকে। প্রতিদিন বিকেল বেলা গ্রামের বিভিন্ন পেশার লোকজন ও অন্যগ্রামের লোকজনও এখানে বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে বছরে দুটো ঈদে এখানে বেশি লোক সমাগম হয়। তাছাড়া ইদানিং ইটখোলা তৈরি হওয়ায় দর্শনার্থীদের ভীড় বেড়ে গেছে। 
পরদিন বিকাল বেলা সেই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে গেলাম। দেখলাম শত শত নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর বুড়া-বুড়ি সবাই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে আসছে। আমরা একে একে ইটখোলার বিভিন্ন দৃশ্য ও এমপি টিলার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়। তারপর সন্ধ্যা লগ্নে বাড়ি ফিরে আসি।
প্রথম বার গ্রামে এসে রফিকের সাথে আনন্দময় কিছু মূহুর্ত কাটিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে আজ আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। 

রচনাকাল:২০১৪ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: