মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

সিয়াম সাধনা


দিন চলে যায়, রাত আসে এভাবে চলে যায় সপ্তাহ। পার হয়ে যায় মাস। দেখতে দেখতে চলে গেল এগারটি মাস। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেই পবিত্র মাহে রমযান এসে উপস্থিত হল আমার সামনে। সংকেত আসল আর মাত্র একদিন বাকী। মুহূর্তেই মনটা মোচর দিয়ে উঠল।
রমযান উপলক্ষে কলেজ একমাস পনের দিন বন্ধ। ভাবছি এ বছর বাড়িতে গিয়ে রোযার মাসটা কাটাব। তাই কালবিলম্ব না করে আজই কাপড়-ছোপড় গুছিয়ে রওয়ানা হলাম। ঢাকা থেকে বাসে নরসিংদী আসলাম। বাম হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ২:২৫ মিনিট।
হায়! এখন কি হবে, লঞ্চতো ২:৩০ মিনিটে ছেড়ে যাবে।
আর দেড়ি না করে তাই দ্রুত একটি রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম। রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ভাইজান একটু দ্রুত চালান। তা না হলে লঞ্চটা ফেল করতে হবে। তখন আমাকে এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
রিক্সাওয়ালা তার সাধ্যমত রিক্সা চালাচ্ছে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে দৌঁড়ে টারমিনালে ডুকলাম। না, পারলামনা লঞ্চটাকে ধরতে। আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।
সময়ের যে কত মূল্য এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন আমাকে তীর্থের কাকের মতো এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
অন্য কিছু আর চিন্তা ভাবনা না করে ব্যাগ থেকে কিশোরকণ্ঠ পত্রিকাটি হাতে নিয়ে টারমিনালের এক কর্ণারে বসে পড়লাম।
কখন যে এক ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল তা টেরও পেলাম না। লঞ্চ টারমিনালে এসে হর্ণ বাজাচ্ছে। কানে আওয়াজ আসতেই জটপট ওঠে পড়লাম।
সূর্যটা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে। লঞ্চে এসে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। বিকেল পাঁচটায় বাড়ি এসে পৌঁছলাম। সূর্যের আলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে এসেই দেখি মা নামাযের বিছানায় বসে কি যেন ভাবছে। আমি আস্তে করে মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা হঠা পিছনে ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে বললো, কিরে বাবা কখন এলি।
আমি বললাম, এইতো কিছুক্ষণ হয়। কেমন আছ মা?
ভাল, তুই কেমন আছিস।
আমিও ভাল মা।
অনেক দিন যাবত তোকে দেখিনা বাবা। বস আমার পাশে।
আমি চুপ করে মার পাশে বসে পড়লাম। তারপর বললাম, মা আমি এ বছর রোযার মাসটা বাড়িতে কাটাব।
মা বললো, বেশ ভাল কথা, আমিও তো চাই তুই অন্তত রোযার মাসটা আমার কাছে থাকবি।
মা মুহূর্তে আবার বললো, যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নে, কখন না কখন খেয়ে আসছিস। তাছাড়া আজ চাঁদ উঠলে কাল থেকে রোজা রাখতে হবে আর দিনে খেতে পারবি না।
তাই বলে এখন এ অসময়ে আমাকে খেতে হবে!
তাতে কি হয়েছে। অনেক দিন তোকে খাওয়াইনি। আজ আমি তোকে নিজের হাতে খাওয়াব। প্রতিটি মা কামনা করে তার সন্তান তার পাশে বসে খাক। যা জলদি যা হাতমুখ ধুয়ে আস।
এসব কথা বলতে বলতে মার চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি জমে গেছে।
মার পিড়াপিড়িতে ভাত না খেয়ে পারলাম না। কারণ মাকে যে, আমি অনেক ভালোবাসি।
বিকেলের সূর্যটা ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে দেহের উত্তাপ হারিয়ে ফেলছে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ পাশে বিল। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বিলের পাড় আসলাম। নরম কোমল রোদ এসে গায়ের উপর পড়ে দেহের শিরায় উপশিরায় মিশে যাচ্ছে। আর একটু পরেই রক্তিম সূর্যটা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে চলে যাবে। তখন হয়তো বা কে‌উ তাকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারবে না।
আমি অপলক দৃষ্টিতে রক্তিম সূর্যটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের সামনে সূর্যটা বৃন্তচুত্ত্য কমলার মতো টুপ করে পৃথিবীকে নিমিষে অন্ধকার করে চলে গেছে। এদিকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে পবিত্র মাগরিবের আযানের সুর ভেসে আসছে। আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। চাঁদ এখনো উঠেনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চাঁদ দেখার জন্য এতক্ষণে বিলের পাড় এসে ভিড় জমাচ্ছে।
আমি দ্রুত মসজিদে এসে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। তারপর ফিরে আসলাম আবার বিলের পাড়ে। পশ্চিমাকাশে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম পবিত্র মাহে রমযানের এক ফাঁলি রূপালী চাঁদ কাস্তের মত বাঁকা হয়ে উঠছে। আমি সাথে সাথে চাঁদ দেখার দোয়া পড়ে নিলাম।
ছেলে-মেয়েরা পশ্চিম দিগন্তের দিকে ফিরে একে অপরকে আঙ্গুঁল দিয়ে দেখিয়ে বলছে, ঐ আকাশে চাঁদ উঠেছে, কাল থেকে রোযা রাখতে হবে। এই আনন্দে সবাই মেতে উঠল। মসজিদের হুজুর মাইক দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে আজ থেকে তারাবি পড়তে হবে। সবাইকে সাড়ে সাতটায় মসজিদে আসতে বলা হয়।
গোধূলী বেলার ম্লান আভা ছড়িয়ে পড়ছে সারা আকাশে। অসংখ্য তারা আকাশে মিট মিট করে আলো দিচ্ছে। কিন্তু চাঁদ এতক্ষণে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে।
তারাবি নামায পড়ে বাড়িতে আসতেই মা বলল, বাবা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। ভোররাতে উঠতে হবে। মার কথায় সাথে সাথে শুয়ে পড়লাম।
আমি ঘুমিয়ে আছি। কখন যে আমার মা ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে বসছে তা বলা মুশকিল।
রান্না শেষ করে মা আমাকে এসে ডাক দিল। মার ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গল। কিন্তু পরক্ষণেই চোখের পাতায় আবার ঘুম আসছে। হালকা শীত প্রকৃতির বুকের উপর পড়ছে। শয়তান আমাকে উঠতে দিচ্ছে না।
আবার মা এসে ডাকছে, কি ব্যাপার তুই এখনও উঠছনি। তাড়াতাড়ি আস, চারটা পনের বাজে।
আমি তখন ঘুমকাতর স্বরে বললাম, আসছি মা তুমি যাও। একথা বলে লেপটাকে একটা লাথি মেরে শয্যা থেকে উঠে পড়লাম। ব্রাশ, টুথপেস্ট হাতে নিয়ে কলের পাড় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে ঘরে ঢুকলাম।
মা, বোন ও আমি খেতে বসলাম। কিন্তু ছোট ভাই রবিউল্লাকে ডাকলেন না মা।
কখন যে ছোট ‍ভাইটি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আমার পাশে এসে বসল তা টেরও পেলাম না।
মা ওকে দেখতে পেয়ে রাগের ভাব ধরে বললো, তুই কিসের জন্য এসেছিস। যা ঘুমা গিয়ে, সকালে খাবি।
সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, মা আমি রোযা থাকব।
না তোর রোযা থাকতে হবে না।
আমি বললাম, সে যখন খেতে চাচ্ছে ‍তাতে তোমার অসুবিধাটা কোথায়?
মা বললেন, ছোট মানুষ রোযা থাকলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। আর এমন না যে, তার বার বছর হয়ে গেছেযে, তাকে রোযা রাখতেই হবে।
তার যখন সখ রোযা থাকতে থাকুক। এতে গুনাহ হবে না। রোযা রাখার অভ্যাস এখন থেকেই করতে হবে। তুমি ওকে খেতে দাও।
মা আর আমার কথার প্রতিউত্তর করলেন না।
ভাইটি চুপটি করে আমার পাশে বসে আছে কিছুই বলছে না।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কিরে মুখ ধুলিনা। জলদি যা দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ‍আস।
সে দ্রুত মুখ ধুয়ে এসে আমার পাশে পিড়ি নিয়ে বসে পড়ল।
আমার মনে পড়ে গেল আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। তখন রোযা হতো বৈশাখ মাসে। তখন গাছে গাছে আম কাঁঠাল পাকত। আমাদের চারটি আম গাছ ছিল। প্রতিটি গাছেই আম আসত। সে সময় মা আমাকে রোযার দিনে ভোর রাতে ডাক দিতেন না। কারণ আমি তখন ছোট ছিলাম। প্রতিদিন মা-বাবা আম দুধ দিয়ে সেহরী খেত। আমি ঘুম থেকে ওঠে আমের বড়াগুলি দেখতাম। তবে আমাকে মা দিনের বেলা প্রচুর আম দিত। আমি তখন কাঁদতাম কেন আমাকে ভোর রাতে ডাক দিলে না।
মাঝে মাঝে রাতে উঠলে মা আমাকে ধমক দিত। তখন সুপারিশ করার মতো কেউ ছিল না। তাই রোযা থাকতে পারি না। কিন্তু আজ আমি সুপারিশ করতেই মা ছোট ভাইটিকে খেতে দিল।
সেহরী খেয়ে ফযরের নামায পড়লাম। আকাশ একটু ফর্সা হচ্ছে। শীতে শির শির করে কাপঁছি। চোখের পাতায় ঘুম আসছে। তাই আবার শুয়ে পড়লাম। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম।
দুপুরকে আস্তে করে ঠেলে বিদায় করে দিয়ে বিকেল আশ্রয় নিল প্রকৃতির বুকে। রোদের তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। আকাশে একটুও মেঘের আভা নেই।
আমার একটু একটু খিদে লাগছে। কিন্তু মনকে এ বলে শান্ত্বনা দিলাম যে, এইতো আর অল্প কিছুক্ষণ বাকী।
এদিকে ছোট ভাইটি এখনও রোযা ভাঙ্গেনি। মা কতবার বললো, রোযা ভেঙ্গে ফেলার জন্য কিন্তু কিছুতেই সে ভাঙ্গেনি। তার পেট খিদে চোঁ চোঁ করছে। সে পেটটি নিচের দিকে দিয়ে খাটে শুয়ে আছে।
এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। রেডিওতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে। রেডিও ছেড়ে দিলাম। সবাই কুরআন তেলাওয়াত শুনছে।
আমি দোকান থেকে মুড়ি, বুট, ডালের বড়া নিয়ে আসলাম।
সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল রং ধারণ করেছে, একটু পরেই ডুবে যাবে। চারদিক হালকা অন্ধকার হয়ে আসছে।
কোরআন তেলাওয়াত শেষ। আমরা সবাই পাটি বিছিয়ে ইফতারি সামনে নিয়ে বসে পড়লাম। ছোট ভাইটি আমার পাশে বসল। আযান দেওয়ার সাথে সাথে রোযা ভেঙ্গে ইফতারি শুরু করলাম। এর মধ্য দিয়ে একটা রোযা পূর্ণ হয়ে গেল।
রচনাকাল- জানুয়ারি ২০০০ খিস্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই: