রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬

নরসিংদীর কিংবদন্তীর প্রাণপুরুষ সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক


নরসিংদীর কিংবদন্তীর প্রাণপুরুষ সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক আজ আর আমাদের মাঝে নেই, একথা ভাবতেই চোখে জল এসে যায়। তিনি যে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মানুষ মরণশীল। কেউ অমর নয়। কেউ আগে বা কেউ পরে এ দুনিয়া থেকে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। তাই সে নিয়মেই সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেব আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন। দেখতে দেখতে দশটি বছর চলে গেল। এখন তিনি একা ঘুমিয়ে আছেন নরসিংদীর আশরীনগরের বটতলায়। ২৭ মার্চ তাঁর দশম মৃত্যুবার্ষিকী। দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ব্যক্তিগতভাবে সামসুদ্দীন আহমেদ এছাকের সাথে আমার কোন কথাবাতা হয়নি বা তাঁর কোন সানিধ্য পায়নি। আমি যখন ২০০৩ সনের আগস্ট মাসে নরসিংদীতে আসি, তখন থেকেই শুনতে পাই তিনি অসুস্থ। ২০০৪ সনের প্রথম দিকে যখন আরশীতে মুখের কর্তৃপক্ষের সাথে আমার পরিচয় হয় তখন আমি প্রায়ই আরশীনগর যেতাম। তখন দেখতাম অসুস্থ এছাক সাহেব বটগাছের নিচে বসে থাকতেন। তাঁর অসংখ্য ভক্ত তাকে দেখার জন্য আরশীনগর আসত। তখন আমার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি। তখন যদি জানতাম যে তিনি এভাবে অকালে চলে যাবেন তাহলে তাঁর চরণধুলি নিয়ে ধন্য হতাম।
সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেবের গুনের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা, ছড়াকার, ন্যায়বিচারক, প্রকৃতি প্রেমিক, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। বাস্তবে তিনি বিলাসী জীবন যাপন না করে সাদাসিধেভাবে সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করতেন তার প্রমাণ ওনার পোশাক আশাকে পাওয়া যেত। তিনি সর্বদা সাধারণ ফতোয়া ও লুঙ্গী পরিধান করতেন। শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষের পক্ষে তিনি ছিলেন অটল। সাংস্কৃতিক ধারক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সংগীত একাডেমী। তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান, কবিতা, নাটক। সুর করেছেন বহু গানে। বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকারও ছিলেন। এসবের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি থাকবেন চির অম্লান হয়ে।
প্রকৃতি প্রেমিক সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক গাছপালা, ফুল, লতাপাতা, পশু পাখিকে যে কতটুকু ভালবাসতেন তা শুধুমাত্র তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যে অনুভব করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে তিনি তৈরি করেন নরসিংদীর একমাত্র বিনোদন পার্ক ‘আরশীনগর পার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানা।’ কোন দর্শনার্থী যখন তাকে খুঁজত তখন তাকে কোথাও পাওয়া না গেলেও এই আরশীনগর পার্কে পাওয়া যেত।  
সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেবের জনপ্রিয়তা যে কতছিল তাঁর প্রমাণ নরসিংদীর সদর আসন থেকে ৪ বার এমপি নির্বাচিত হওয়া। আমার মনে হয় তিনি যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তবুও যেকোন প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করতে পারতেন।
সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেব যে কতটুকু সাহিত্যমনা ছিলেন তার উজ্জ্বল প্রমাণ নরসিংদী থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আরশীতে মুখ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করা এবং এতে নিয়মিত সাহিত্য পাতা চালুকরন। যা নরসিংদীর অন্য কোন পত্রিকায় নেই। তবে বর্তমানে কয়েকটি পত্রিকায় সাহিত্য বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত নয়। অত্র পত্রিকার সাহিত্য পাতায় গল্প, কবিতা ছাপানো হয়। এই সাহিত্য পাতার মাধ্যমে ইতোমধ্যে অসংখ্য তরুণ কবি সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে।
তখন আমি নরসিংদী সরকারী কলেজে পড়তাম এবং সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লিখতাম। স্থানীয়ভাবে সাহিত্য চর্চার একটা সুযোগ করে দেয় এই আরশীতে মুখ। নরসিংদীর তরুণ কবি সাহিত্যিকরা যখন কোন মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিল না তাদের সৃজনশীল প্রতিভা প্রকাশ করার জন্য, তখনই হয়তো এই আরশীতে মুখের ছোঁয়া পেয়ে তারা ধন্য হয়েছে। আজকের এই সব ক্ষুদ্র লেখকরা হয়তো একদিন নামকরা কবি, সাহিত্যিক হবে। যারা বয়ে আনবে দেশের সম্মান। আর আমার কথা কি বলব, আমিওতো এ পত্রিকার থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। যদিও আমি এ পত্রিকার পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকায় লেখালেখি করি তারপরও বলব, এ পত্রিকার অবদান কোন অংশে কম নয়। আমি এ পত্রিকা থেকে অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি যা কোন পত্রিকা থেকে শিখতে পারিনি। আর একটি কথা না বললে হয়তো আমার লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তা হচ্ছে- আজকের লেখক হওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন- ‘আরশীতে মুখ’ ত্রিকার সহকারী সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ভাই। যার উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সহযোগিতায় আমি আজকের এতটুকু পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি। বলতে পারেন তিনি আমার সাহিত্যের গুরু।
সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেবের ইচ্ছে ছিল তার সৃষ্টি আরশীতে মুখ যেন কোন দিন বন্ধ না হয়। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা যেন এখানে সাহিত্য চর্চা করতে পারেন। এখনও সেটি চলমান আছে তবে তিনি মৃত্যুবরণ করার পর হয়তো তার উত্তরসুরীরা নিয়মিত প্রকাশ করতে পারছেন না। আমি চাই এই পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে প্রকাশ হউক। বাস্তবে সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সাহেব মরে গেছেন। কিন্তু তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্য দিয়ে। যুগ যুগ ধরে তাকে স্মরণ করবে নরসিংদী তথা বাংলাদেশের অসংখ্য ভক্তরা।    


রচনাকাল: ২৬/০৩/২০১৫ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: