রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

আর কত লাশ দেখব আমরা

২৪ এপ্রিল ২০১৩ বুধবার সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধস হয় সাভারের রানা প্লাজায়। সে ভবনে ছিল দোকানপাট, একটি ব্যাংক ও পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানা। আগের দিন মঙ্গলবার রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়। সে ফাটলের দৃশ্য টিভিতে প্রচার করা হয়েছিল। কয়েকটি দৈনিকে খবর ছাপানো হয়েছিল। স্বভাবতই পোশাক শ্রমিকরা শঙ্কিত হয়েছিল। তারা কারখানা বন্ধ
রাখার জন্য আকুতি-মিনতি করেছিল মালিকের কাছে। মুনাফার লোভে মালিক তাদের আকুতি-মিনতিতে কর্ণপাত করেনি। এরা শ্রমিকদের এ বলে সান্ত্বনা দেয় যে, রানা প্লাজা সম্পূর্ণ নিরাপদ। চাকরী হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে সেদিন মৃত্যুর মুখে এসে কাজে যোগ দেয়। আর তখনই মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ে রানা প্লাজা। মুহূর্তের মধ্যে কিছু বুঝে উঠার আগেই একের পর এক লাশ বের হতে থাকে রানা প্লাজা থেকে। এ কলাম লিখার আগ পর্যন্ত ৩৬২ টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৩৪৩৬ জন। এখনও উদ্ধার কাজ চলছে। জানিনা আর কত লাশ এখান থেকে উদ্ধার হবে। দিন যতই যাচ্ছে লাশের মিছিল ততই বাড়ছে। 

এমন এক পরিস্থিতি আমাদের দেশের মাননীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাভারের গার্মেন্ট দুর্ঘটনা নিয়ে এক নাড়াচড়া তথ্য দিয়েছেন, যা জাতির সামনে এক হাস্যকর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২৪ এপ্রিল বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্টমন্ত্রী বলেন, হরতালকারীরা এসে এই ভবনে ধক্কাধাক্কি করেছিল বলেই ভবনটি ধসে পড়েছে। তাঁর কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেছি। একি বলছে স্বরাষ্টমন্ত্রী! তাও কি সম্ভব? আট তলা একটি বিল্ডিং কিছু মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। তাঁর একথা বলার জন্য স্বরাষ্টমন্ত্রীকে কি বলে যে বিশেষায়িত করব তা আমার জানা নেই। এই যদি হয় আমাদের দেশের মন্ত্রীর কথাবার্তা তাহলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি তাদের কথাবার্তা কি হবে তা বলা বাহুল্য।
২৪ এপ্রিল ১৮ দলের হরতাল ছিল। এ ঘটনা জানার পর পর ১৮ দল হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় এবং পরের দিন ১৮ দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া উদ্ধার কাজ দেখতে যান। অন্যদিকে এই ঘটনার পর নিয়মিত রুটিন অনুসারে ট্রেন উদ্বোধন করতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফাটলের কারণে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। শ্রমিকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আনতেই কারখানায় ঢুকেছিল। তিনি আরো বলেন, ভবনের মালিক সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। এখন আমার প্রশ্ন হলো কারখানা যদি বন্ধই থাকে তাহলে এত লোকের জীবনহানী কেন? এত লোক উদ্ধার হলো কোথা থেকে। শ্রমিকদের এমন কি মূল্যবান জিনিস আছে যা কারখানার ভেতর রাখতে হয়। আর তা আনতে হাজার হাজার লোক ভবনের ভিতর প্রবেশ করে।
টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একে ধরো তাকে মারো এসব কথা না বলে আপনারা সাভারে গিয়ে যদি লোকজনকে উদ্ধার করেন তাহলে লোকজন উপকৃত হবে। একথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলতেই পারেন। কারণ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওনিতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেখানে গিয়ে উদ্ধার কাজ দেখা উচিত ছিল। 
আমাদের দেশে যেকোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। এতবড় একটা ভয়াবহ ধস নেমে এসেছে জাতির সামনে এ নিয়ে আমরা রাজনীতি করতে পারিনা। এ সমস্যা কোন দলের নয় এটা জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনীতি না করে দলমত নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসতে হবে। সোহেল রানা কোন দলের তা সনাক্ত করার সময় এখন নয়। এখন তাকে গেফতার করে আইনের আওতায় আনা সরকারের উচিত। নিশ্চিত বিল্ডিং ফাটল জানা সত্ত্বে কার ইশারায় এত লোক এখানে আসে, কেন আসে তা সনাক্ত করার সময় এখন।
আমরা এ সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই যা দেখলাম তা জাতিকে হতবাক করে দেয়। সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ঢাকায় পিলাখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৭৩ জন নিহত হওয়ার কাহিনী শুনলে এখনও বুক কাপে। তারপর ১১ ডিসেম্বর ২০১১-তে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতে গিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ৫৩ স্কুল ছাত্রের মর্মান্তিক প্রাণহানি যা জাতির জন্য কত ক্ষতিকর তা বলাবাহুল্য। ২৪ নভেম্বর ২০১২-তে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগে ১১১ কর্মীর পুড়ে মারা যায়। এর দুইদিন পর ২৬ নভেম্বর ২০১২-তে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট পুকুরপাড়ে নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৫ জন নিহত। এরপরও আমরা সর্তক হয়নি। যার পরিনামে ভবনে ফাটল জানা সত্ত্বেও ২৪ এপ্রিল ২০১৩-তে সাভারে সকাল ৯ টার দিকে নয়তলা ভবন রানা প্লাজায় ধসে শত শত লোকের প্রাণহানী যা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা।   
রচনাকালঃ ২৮ এপ্রিল ২০১৩ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: