শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৪

তবুও নির্বাচন হচ্ছে


নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান নিয়ে দেশে আজ ক্লান্তিকাল চলছে। স্বাধীনতার পর এত চরম অবস্থা আর কখনো হয়নি। সরকারের একগুয়েমি আর বিরোধীদলের মারমুখী আচরনে দেশের সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ। দু’দলের ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ জনগণের বারটা বেজে যাচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। কখন জানি ককটেল, বোমা, পেট্রোল বোমার বা পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায়। কখন জানি আগুনের কবলে পড়ে কংকাল হতে হয়।
বাংলাদেশ এমন ক্লান্তিকাল অতিক্রম করবে তা কখনো সাধারণ জনগণ কল্পনাও করেনি। আজ জনগণ মরছে গুলিতে। মরছে বোমার আঘাতে। মরছে আগুনে পুড়ে। আগুনে পুড়ে তাদের শরীর কয়লা হচ্ছে। মরছে পুলিশের গুলিতে। মরছে কথিত ক্রসফায়ার বর্তমান নাম বন্ধুক যুদ্ধে। মরছের যৌথ বাহিনীল ‍অভিযানে। মরছে লগি বৈঠার আঘাতে। সাধারণ জনগণ পড়েছে ভয়াবহ সংকটে। এত মৃত্যু, এত ধ্বংস, এত আগুন, এত হিংসা, এত জীবনহানী ও জীবিকার ওপরে এমন নিষ্ঠুর আঘাত জনগণ কখনো দেখেনি।
দেশের প্রতিটা নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কৃষিকাজ। নষ্ট হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। নষ্ট হচ্ছে শিল্প-কারখানা। নষ্ট হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। রাজনৈতিক হানাহানিতে ধ্বংস হচ্ছে এদেশ। স্বাধীনতার ৪৩ বছরও পরও আমাদেরকে এ দৃশ্য দেখতে হবে তা কখনো কেউ ভাবেনি। আমরা কি আজও স্বাধীন হতে পেরেছি? কোন না কোন দলের কাছে আমরা আজ পরাধীন। তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছায় আমাদেরকে চলতে হয়। গণতন্ত্র আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কথা বলার অধিকার নেই। ভোট দেয়ার আধিকার নেই। দেশের ৫২% লোক আজ তাদের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা পাচ্ছে না। বাকী ৪৮% লোকও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেনা। আমরা অতীতে ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছি কিন্তু প্রার্থীবিহীন নির্বাচন দেখিনি। আজ আমাদেরকে তাই দেখতে হচ্ছে। এ লজ্জা কোথায় রাখব। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে লজ্জায় মাথা হেড হয়ে যায়। একোন স্বাধীন দেশে আমরা বসবাস করছি।
চরম অনিশ্চয়তার মাধ্যমে এদেশের জনগণের দিন পার হচ্ছে। এর কোন সমাধান দেখছে না জনগণ। যতই দিন যাচ্ছে ততই ভয়াবহ হচ্ছে ক্ষোভের আগুন। সামনে সিডরের মতো ধেয়ে আসছে রক্তাক্ত হানাহানি, জ্বালাও পোড়াও, প্রাণহানি, সম্পদহানির আশঙ্কা রাজনৈতিকভাবে দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আর্ন্তজাতিক অঙ্গন থেকেও। একঘরে হয়ে যাচ্ছে সরকার। যেখান থেকে বেরোনোর উপায় আমাদের জানা নেই। আর কত রক্ত আমাদেরকে দেখতে হবে? আর কত রক্তের বন্যা বইলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল হবে? মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। গেল বছর যেন মৃত্যুর এক বছর পার করছে বাংলাদেশ। এত মৃত্যু স্বাধীনতার পর এদেশের জনগণ দেখেনি। দেশের রাজনীতি যেন দিনে দিনে মানবিক চেহারা পরিবর্তন করে নির্দয়, নির্মম ও হিংস্র চেহারায় রূপ নিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই ভঙ্কর রূপ নিচ্ছে।
২০১২ সালে আমরা দেখেছি রাজপথে বিশ্বজিতের মতো অসহায় সাধারণ মানুষকে কিভাবে ‍পিটিয়ে বা কুপিয়ে বর্বরভাবে হত্যার করা হয়েছে। কিন্তু গেল বছর দেখছি  জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে। মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, মৃত্যু কত যন্ত্রণাদায়ক তা হারে হারে টের পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিসাধীন মানুষগুলো। ক্ষমতালিপ্সুদের হত্যার রাজনীতিকে অভিসম্পাত করা ছাড়া আর কিছুই তাঁদের নেই। তারা এ নোংরা রাজনীতিকে অসুস্থ্য রাজনীতি আখ্যা দিয়েছে। এ নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে যারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকে উপলব্ধি করতে পারেনি এসব ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদরা। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তাদেরকে ভসনা করছে।         
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এখন রাজনীতির নামে চলছে হানাহানি, মারামারি, খুনাখুনি, ককটেল ফুটানো, বোমা ফুটানো। এদেশের রাজনীতি থেকে সভ্যতা, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার জন্য তারা নিজের আপনজনকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এদেশে কোন আইনের শাসন নেই। নির্দোষ ব্যক্তি সাজা পায় আবার ফাঁসির আসামী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা পায়। এটা এক আজব দেশ!
এদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ ‍আর হরতাল-অবরোধ চায় না। জীবন্ত মানুষ পুরানো চায় না। হানাহানি চায় না। মারামারি চায় না। গাড়ী ভাংচুর চায় না। গুলিবিদ্ধ লাশ চায় না। রাজনৈতিক কার্যালয়, বাসা বাড়ি, গার্মেন্টেস এ আগুন চায় না। প্রার্থীবিহীন নির্বাচন ‍চায় না। নির্বাচনের নামে ৩০০ কোটি অর্থের ‍অপচয় ‍চায় না। জনগণ নাস্তিক আস্তিক নিয়ে দ্বন্ধ চায় না। জনগণ হেফাজত চায় না। জনগণ শাহবাগ চায় না। জনগণ ক্ষমতা চায় না। জনগণ হাসিনা খালেদা চায় না। জনগণ এরশাদ বা গোলাম আযমও চায় না। জনগণ লাশ চায় না। জনগণ পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে চায় না। জনগণ রাজনীতির হিংস্র থাবার শিকার হতে চায় না।
এদেশের জনগণ শান্তি চায়। জনগণ এ রক্তপাত থেকে মুক্তি চায়। জনগণ স্বস্থি চায়। ঘুমানোর সময় নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়। অবাধে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে চায়। ভোট দেয়ার সাংবিধানিক অধিকার চায়। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল চায়। কারণ কেউ জনগণের উন্নয়ন করে দিতে পারবে না। তাদের উন্নয়ন তাদেরকেই করতে হবে। তাইতো সাধারণ জনগণের রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন আর কত রক্তের বন্যা বইলে এ অর্থহীন নির্বাচন বন্ধ হবে? আর কত মানুষের জীবনহানী হলে এ নির্বাচন বন্ধ করে দু’দল শান্তিপূর্ণ সমাধান করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে যাবে?
লেখক- উপন্যাসিক, কলামিষ্ট

কোন মন্তব্য নেই: