বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

সাপ্তাহিক আরশীতে মুখ ও প্রয়াত গণমানুষের নেতা সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক

এক.
২০০৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর বানিয়াছলের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। এ বাসায় রুবেল নামের একটি ছেলে প্রায়ই আসত। একদিন তার সাথে আমার পরিচয় হয়। পরিচয় পর্বে জানতে পাররাম সে একজন তরুণ কবি। স্থানীয় পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশ হয়। আমি তার বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েছি। ভাল কবিতা লিখে সে। সে নরসিংদীর বটতলায় একটি মোবাইলের দোকানে বসত। মাঝে মাঝে আমি সেখানে গিয়ে বসতাম। সে যখন জানতে পেল আমিও
একজন তরুণ লেখক ও বাজারে আমার একটি ‘এ জীবন শুধু তোমার জন্য’ শিরোনামে উপন্যাস বই আছে। তখন সে আমার সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গঢ়ো করে ফেলল। যদিও সে আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। ইতোমধ্যে আমার অসংখ্য লেখা মাসিক, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন, কিশোর পত্রিকাগুলোতে ছাপানো হয়েছে। কিন্তু কোন স্থানীয় পত্রিকায় আমার কোন লেখা ছাপা হয়নি। কারণ কোন স্থানীয় পত্রিকায় আজ পর্যন্ত আমি লেখা জমা দেইনি। একদিন রুবেল আমাকে বলল, আমির ভাই, ‘আপনিতো ইচ্ছে করলে স্থানীয় পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করতে পারেন। বিশেষ করে ‘আরশীতে মুখ’ নামে নতুন একটি পত্রিকা বের হয়েছে সেখানে লিখতে পারেন। সেখানে নবীন লেখকদের জন্য একটি সাহিত্য পাতা আছে। এটি আরশীনগর থেকে প্রতি বুধবার প্রকাশ হয়। সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক এমপি এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।’
সেদিনের রুবেলের কথায় ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকায় লেখার আগ্রহ জন্মালো। একদিন আমার ক্লাশমেট দেলোয়ারকে নিয়ে আরশীনগর সম্পাদকীয় কার্যালয়ে গেলাম। সেখানে তখন ছিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোঃ কাউছার ভাই। দেলোয়ারও একজন তরুণ কবি। সে একটি কবিতা নিয়ে আসল। আমিও “শুধু তোমার কারণে” শিরোনামের কবিতাটি নিয়ে আসলাম। আমরা প্রথমে কাউছার ভাইয়ের সাথে আলাপ করি। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কোন ধরণের কবিতা আপনারা ছাপান।?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন মানসম্মত হলে অবশ্যই ছাপাই।‘ তখন আমরা দুজনে দুটো কবিতা কাউছার ভাইয়ের হাতে দিয়ে চলে আসলাম।
পরের সপ্তাহে বুধবার সকালে আমরা আরশীনগর যাই। কাউছার ভাই আমাদেরকে দেখেই বললেন, বসো। তারপর দুজনের হাতে দুটো পত্রিকা দিলেন। আমি প্রথমেই ‘সাহিত্য পাতায়’ চোখ রাখলাম। বন্ধুর কবিতাটি ছাপানো হয়েছে কিন্তু আমার কবিতাটি ছাপানো হয়নি। তারপরও আমার মন খারাপ হয়নি। কারণ আমি মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় আমার কবিতার চেয়ে বন্ধুর কবিতাটি মানসম্মত হয়েছে। তা না হলে আমারটি ছাপাবে না কেন? আমি তখন আর কাউছার ভাইকে কিছু বলিনি। চুপচাপ বন্ধুর সাথে চলে আসলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম বন্ধুর চেয়ে ভাল কবিতা লিখব এবং সময়োপযোগী লেখা লিখব।
পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি কে নিয়ে ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখে ফেললাম। পরের সপ্তায় ঈদ-উল-আযহার বন্ধ থাকায় পত্রিকা প্রকাশ হয়নি। তাই কবিতাটি জমা দিতে পারিনি। ঈদের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি কবিতাটি নিয়ে আরশীনগর যাই। সেদিন সেখানে বসা ছিলেন ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ভাই। রিপন ভাইয়ের সাথে পরিচয় পর্বের শেষে দীর্ঘক্ষণ বসে কথাবার্তা বললাম। তারপর রিপন ভাইয়ের হাতে কবিতাটি দিয়ে বললাম, দেখেনতো কেমন হয়েছে? ছাপার উপযোগী হয়েছে কিনা? না হলে আরেকটি কবিতা দেব।’ রিপন ভাই কবিতাটি মনযোগ দিয়ে পড়ে বললেন, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। এ সংখ্যায় অবশ্যই ছাপাবো। আপনি বুধবার সকাল দশটার দিকে আসবেন আমাকে পাবেন। পরে কথা হবে।‘ সেদিনের মতো চলে আসলাম।
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ বুধবার সকালে আরশীনগর যাই। সেদিন রিপন ভাই ও কাউছার ভাই দুজনকেই দেখতে পেলাম। টেবিল হতে পত্রিকাটি হাতে নিয়েই দেখতে পেলাম আমার কবিতাটি ছাপানো হয়েছে। তখন মনে মনে খুশী হলাম ও রিপন ভাইকে ধন্যবাদ দিলাম।
‘ধুমপানে বিষপান’ নামে একটি কবিতা রিপন ভাইকে দিয়ে চলে আসলাম। পরের সপ্তাহে এটিও ছাপানো হয়। এর পরের সপ্তাহে ‘টোকাই’ নামের একটি কবিতা ছাপানো হয়। এভাবে পর্যাক্রমে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এ পর্যন্ত মোট ২৪টি কবিতা ছাপানো হয়েছে। কবিতা তেমন ভাল লিখতে পারি না তাই কবিতা লেখা কমিয়ে দিয়েছি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান অবস্থা” শিরোনামে আমার একটি লেখা ১৭ মার্চ ২০০৪ প্রকাশিত হয়। সেই লেখাটি পড়ে অনেক বন্ধু বান্ধব মন্তব্য করেছে, কবিতার চেয়ে এসব আর্টিকেল বা কলাম জাতীয় লেখা নাকি বেশ ভাল লিখতে পারব। সেদিন থেকে কবিতা লেখা কমিয়ে কলাম লেখায় মনযোগ দেই। এর কয়েক মাস পর কবিতা লিখা একদম বাদ দিয়া দেই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ৩৪টি উপ-সম্পাদকীয় ও কলাম প্রায় নিয়মিতভাবেই এই ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো- ২১ আগস্টের বোমা হামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে (১ সেপ্টেম্বর’০৪), ড. হুমায়ুন আজাদ একজন স্বঘোষিত নাস্তিক এবং তার জানাযা ও দাফন-কাফন (৮ সেপ্টেম্বর’০৪), ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৪-এর সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ‘র‌্যাবের ক্রসফায়ার নাটক’ এবং আমার কিছু কথা (১৩ অক্টোবর’০৪), জোট সরকারের তিন বছর সাফল্য ও ব্যর্থতা (২০ অক্টোবর’০৪), ওয়াদা ভঙ্গকারী শেখ হাসিনার মিথ্যাচার এবং স্বঘোষিত জাতীয় মোনাফেক, (২৪ নভেম্বর’০৪), অপসংস্কৃতি ও আজকের তরুণ সমাজ, (৫ জানুয়ারি’০৫), প্রসঙ্গঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও আমার কিছু কথা, (২৫ মে’০৫), কেন বার বার লঞ্চ দুর্ঘটনা, (১ জুন’০৫), প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে একাধিক প্রাণ, (১৫ জুন’০৫), পতিতাবৃত্তিকে রোধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, (৬ জুলাই’০৫), বোমা হামলাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, (২৪ আগস্ট’০৫) ইত্যাদি কলাম লিখে ইতোমধ্যে বেশ প্রশংসিত হয়েছি। তাছাড়া এ পত্রিকায় বেশ কয়েকটি গল্প ও ভ্রমণকাহিনীও লিখেছি। এখন বন্ধুবান্ধবরা আমাকে তরুণ কলামিষ্ট হিসেবে ডাকে। এই যে বিশাল প্রাপ্তি এর অবদান একমাত্র ‘আরশীতে মুখে’র। যার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। এখন এই আরশীতে মুখের সাথে আমি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছি। সময় উপযোগী নিয়মিত লেখার চেষ্টা করছি।

দুই.
আজ ‘আরশীতে মুখ’ দ্বিতীয় বর্ষ শেষে তৃতীয় বর্ষে পদার্পন করছে। একটি পত্রিকার সাফল্য-ব্যর্থতা দুই থাকতে পারে। আপনারা হয়তো এর ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। ত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিকের কিছুই নয়। তবে আমি দেখেছি এর সাফল্যের পাল্লাই ভারি বেশি। কারণ আমি দেখিনাই এই দুই বৎসরে কোন সংখ্যা অপ্রকাশিত হতে। শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে প্রতি বুধবার আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে এই আরশীতে মুখ। নরসিংদী শহর থেকে অনেক দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হচ্ছে। কিন্তু সবকটি পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। অনেক পত্রিকা আছে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। সেইদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে আরশীতে মুখ পত্রিকা দুই বৎসর স্বল্প সময় হলেও কোন অনিয়ম হয়নি। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় পত্রিকাটি হাটি-হাটি পা-পা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
এই পত্রিকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- নিয়মিতভাবে ‘সাহিত্য’ পাতা নামে একটি বিভাগ চালু আছে। যা নরসিংদীর অন্য কোন পত্রিকায় নেই। তবে বর্তমানে কয়েকটি পত্রিকায় সাহিত্য বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত নয়। অত্র পত্রিকার সাহিত্য পাতায় গল্প, কবিতা ছাপানো হয়। এই সাহিত্য পাতার মাধ্যমে ইতোমধ্যে অসংখ্য তরুণ কবি সাহিত্যিকের বলয় তৈরি হয়েছে। যেমন- মশিউর রহমান দুর্জয়, এম.এ. ইউসুফ, রাকিব হাসান রুবেল, মহিদুল ইসলাম শাহ আলম, লিসনাত হাকিম চাঁদনী, আর.কে. পরশ, হোমায়রা বুশরা, আজাদ হোসেন ডালিম, নাজমুল হক, সাইফুল ইসলাম মামুন, মোঃ তরিকুল ইসলাম, সেলিম শেখ রাজা, মিঠুন চন্দ সরকার, আঁিখ হাসান প্রমুখ অসংখ্য তরুণ কবির জন্ম দিতে পেরেছে একমাত্র এই ‘আরশীতে মুখ পত্রিকা। এইসব তরণ কবি সাহিত্যিকরা যখন কোন মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিল না তাদের সৃজনশীল প্রতিভা প্রকাশ করার জন্য, তখনই হয়তো এই আরশীতে মুখের ছোঁয়া পেয়ে তারা ধন্য হয়েছে। আজকের এই সব ক্ষুদ্র লেখকরা হয়তো একদিন নামকরা কবি, সাহিত্যিক হবে। যারা বয়ে আনবে দেশের সম্মান। আর আমার কথা কি বলব, আমিওতো এ পত্রিকার থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। যদিও আমি এ পত্রিকার পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকায় লেখালেখি করি তারপরও বলব, এ পত্রিকার অবদান কোন অংশে কম নয়। আমি এ পত্রিকা থেকে অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি যা কোন পত্রিকা থেকে শিখতে পারিনি। আর একটি কথা না বললে হয়তো আমার লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তা হচ্ছে- ‘আজকের কলাম লেখক হওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন- ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ভাই। যার উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সহযোগিতায় আমি আজকের এতটুকু পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি। সাহিত্য পাতা ছাড়াও নিয়মিতভাবে বিভিন্ন কলাম ও ইসলামী ভাবধারার লেখা প্রকাশ করে আসছে।
“আমরা নিরপেক্ষ নই, সত্যের পক্ষে বলিষ্ঠ” এই শ্লোগান নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকা। সত্যিই দলমত নির্বিশেষে সকলের সত্য ঘটনাটিই এই পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে।

তিন.
আরশীতে মুখ পত্রিকার দুই বৎসর পূর্তিতে শ্র্দ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সদ্য প্রয়াত নেতা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট, নাট্যকার, গল্পকার, বাংলাদেশ বেতারও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগীত শিল্পী, সাবেক নরসিংদী পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান, নরসিংদী সদর আসন থেকে চারবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত এমপি, আরশীতে মুখের প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক প্রধান সম্পাদক, গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা, ন্যায় বিচারক জনাব মরহুম আলহাজ্ব সামসুদ্দীন আহমেদ এছাককে। বিরল সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী এছাক শিল্প সাহিত্যে রেখে গেছেন অনন্য অবদান। যার উজ্জ্বল দুষ্টান্ত হচ্ছে এই ‘আরশীতে মুখ’ পত্রিকাটি প্রকাশ করা। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃতি প্রেমিক। যার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ‘আরশীনগর পার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানা স্থাপন করে। তা ছাড়া তিনি আরো বহুক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন যা আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে লেখা সম্ভব নয়। কারণ আমি তাঁর সান্নিধ্য পাইনি। দূর থেকে তাকে আমি দেখেছি। মানুষের মুখে মুখে তাঁর প্রশংসা শুনেছি। তাই লেখার শেষ প্রান্তে এসে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক। যার কর্ম যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে নরসিংদীসহ বাংলাদেশের গণমানুষের হৃদয়ে।

প্রকাশকাল: বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০০৫ইং
       

কোন মন্তব্য নেই: