মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

২১ আগস্টের বোমা হামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে

গত ২১ আগস্ট ২০০৪ শনিবার বিকালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে মর্মান্তিক বোমা বিস্ফোরণে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২০ জন নিহত ও শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সাররাদেশে হরতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, অফিস আদালত, দোকানপাট ভাংচুর, গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ১জনকে হত্যা, বিএনপির অফিস ভাংচুর ও আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সারা দেশের পরিস্থিতি উত্তাল করে রেখেছে। এখন তাদের প্রতি প্রশ্ন সন্ত্রাসী ঘটনার জবাব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে কি দেয়া যাবে? এটা কি দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে? যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক তারাতো একটি ঘটনাকে
কেন্দ্র করে এভাবে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে না। এজন্য থাকতে হয় ধের্য, সংযম ও সুষ্ঠু তদন্তের অপেক্ষায়। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে বোমা হামলাকে ইস্যু বানিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকার হটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছে। সরকার গদি থেকে নেমে গেলেই কি সন্ত্রাসীদের বিচার হয়ে যাবে? নাকি সরকারকে ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের বিচার করতে হবে? তারা অপরাধীদের শাস্তি চায় না। তারা চায় সরকারের পদত্যাগ। যাতে তারা আবার ক্ষমতায় গিয়ে বিগত শাসনামলের মত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে পারে। আমরা এই ঘটনার জন্য কোন দলকে তদন্ত ছাড়া এককভাবে দায়ী করতে পারি না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সরাসরি বিএনপিকে দায়ী করেছেন।
বোমাবাজির ঘটনা দেশে আজ নতুন নয়। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ প্রথম বোমা হামলা হয় যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। তখন নিহত হয় ১০ জন। তারপর একই সালে ৮ অক্টোবর খুলনা আহমাদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় নিহত হন ৮ ব্যক্তি। তারপর ২০০১ সালে ২০ জানুয়ারি পল্টনে সিপিবি’র সমাবেশে প্রাণ হারান ৭ ব্যক্তি। ঐ বছরের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে ১০ জন, ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়াচর গির্জায় ১০ জন, ১৫ জুন নারায়াণগঞ্জ আওয়ামীলীগের অফিসে এক অনুষ্ঠানে ২২ জন নিহত হয়। উপরোক্ত ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে আওয়ামীলীগের শাসনামলে। এতে নিহত হয় মোট ৬৭ জন। তৎকালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন পারেনি এই বোমা হামলাকারীদেরকে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি  দিতে। তখন যদি এই বোমা হামলাকারীদের তদন্ত করে শাস্তি দিত তাহলে বর্তমানে দেশে একের পর এক বোমা হামলা ঘটিয়ে সর্বশেষ ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে এতগুলো নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারতো না। অতীতে তারা সন্ত্রাসীদেরকে দুধ কলা দিয়ে পুষেছিল। তাই আজ তারা সেসব সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহায় পাচ্ছে না।
অতীতের সূত্র ধরে বর্তমান জোট সরকারের আমলেও বোমাবাজরা থেমে নেই। একের পর এক বোমা হামলা ঘটিয়ে যাচ্ছে তারা। ২০০২ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার সিনেমা হলে বোমা হামলায় নিহত হয় ৩ জন। ৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ৪টি সিনেমা হলে ২১ জন প্রাণ হারায়। ২০০৩ সালে টাঙ্গাইলে এক পীরের মাজারে ৭জন হামলার শিকার হয়। ২০০৪ সালে ১২ জানুয়ারি ও ২১ মে সিলেটে শাহ জালাল (রহ:) এর মাজারে যথাক্রমে ৫ ও ৩ জন প্রাণ হারায়। ৫ আগস্ট সিলেট সিনেমা হলে ১ জন, ৭ আগস্ট সিলেট গুলশান হোটেলে আওয়ামী লীগের সভায় ১ জন এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০ জন নিহত হয়। উপোরক্ত ৮টি হামলায় ৬১ জন নিহত হয়। বর্তমান সরকারের শাসনামলে।
আওয়ামী লীগ সরকারের মত বর্তমান সরকারও বোমাবাজদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার ফলে বোমা হামলার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। এভাবে যদি বোমা হামলার ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে তাহলে দেশ অচিরেই পঙ্গু হয়ে যাবে। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ২০০১ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী র‌্যালিতে বোমা হামলা চালিয়ে ৮ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তারপর এ বছর সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালুকেও বোমা মেরে হত্যা করা হয়।
এ পর্যন্ত যতগুলো বোমা হামলা হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা হলো গত ২১ আগস্ট। বলা হচ্ছে বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে এ হামলা চালানো হয়। কিন্তু অবাক হওয়ার ঘটনা যে ওনার শরীরে একটু আঘাত লাগেনি। তাই বর্তমান প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া উক্ত ঘটনাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। এর জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়েছেন। সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। শেখ হাসিনাকে সাহানুভূতি জানানোর জন্য সংলাপে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সংলাপে বসার প্রস্তাবটি শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে তার বাসভবনে সাক্ষাত করতে যেতে চেয়েছি, কিন্তু তাতেও তারা অসম্মতি জানিয়েছেন।’’ প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেন, ‘‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বোমা হামলা হচ্ছে, সর্বত্রই ওইসব ঘটনার বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করছে। আমেরিকায় টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায়ও সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রেসিডেন্ট বুশেরর পদত্যাগ দাবী করেনি। কিন্তু আমাদের বিরোধী দল এ ঘটনার জন্য সরকারের পদত্যাগ দাবী করছে।’’
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘কিসের সমঝোতা, কারসাথে সমঝোতা, খুনিদের সাথে কোন বৈঠক নয়। এত বড় ঘটনার পরও যারা সমঝোতার কথা বলছেন তারাও খুনী। কিলারদের সাথে বসবো না। তাদের সাথে কোন আপোষ নয়। তাদের সাথে আপোষ করলে আমি নিহত ও আহতদের পরিবারের কাছে কি জবাব দেব।’’
তারপরও শেখ হাসিনার বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িটি গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে নেয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সুধাসদনে যান। কিন্তু শেখ হাসিনা সাফ জবাব দিলেন, ‘‘গাড়িটিকে গোয়েন্দা হেফাজতে নেয়া যাবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে এখানে এসে করতে হবে। আর আসার দু’ঘন্টা আগে খবর দিয়ে আসতে হবে।’’
শেখ হাসিনার উপরোক্ত কথা থেকে কি বুঝা যাচ্ছে। কেন তিনি তাঁর গাড়ি গোয়েন্দা হেফাজতে দিতে চান না? কেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসতে চান না? কেন তারা বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশের দিন হরতালের আহ্বান করে? তাহলে কি ধরে নিব তারাই সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের সমাবেশে বোমা হামলা ঘটিয়ে ইস্যু সৃষ্টি করেছে? যাতে তারা সরকারকে হটাতে পারে। তা না হলে কেন তারা সরকারের সাথে সমঝোতায় আসতে চায় না? সমঝোতা ছাড়া কি সমাধান করা সম্ভব? তারা কি আদৌ এর সমাধান চায়? আমারতো মনে হয় না তারা এর মীমাংসা চায়। তারা চায় যে কোন ইস্যুকে পুঁজি করে তীব্র আন্দোলন করে সরকারকে পদত্যাগ করাতে, যাতে তারা আবার ক্ষমতায় যেতে পারে। এভাবে হরতাল দিয়ে দেশের ক্ষতি করে কি ক্ষমতায় যেতে পারবে? আমরা তাদেরমত জ্যোতিষী নই তাই আমরা এ মুহূর্তে এ হামলার জন্য কাউকে দায়ী করতে পারি না। আমরা চাই এর সুষ্ঠু তদন্ত। আশা করি তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে যাতে করে আর কখনো এমন ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস না পায়। এটা সকল নাগরিকের প্রত্যাশা।

প্রকাশকাল: বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০০৪ইং

কোন মন্তব্য নেই: