শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬

ইয়াতীমদেরকে ভালোবাসুন

ইয়াতীম শব্দের অর্থ অনেক। বিভিন্ন জন বিভিন্ন অর্থ করেছেন। ইমাম রাগিব ইয়াতীম শব্দের অর্থ লিখেছেন। ‘‘ইয়াতীম বাচ্চার পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই তার পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।’’
সাইয়্যেদ আবদুল দায়েম আল জালালী বলেন, ‘‘ইয়াতীম অর্থ দু:খ, দুশ্চিন্তা, নাবালেগ, বাচ্চাদের বাপহীন হয়ে পড়া।’’   
তবে এর আরো অনেক অর্থ আছে। যেমন- সংকীর্ণ হওয়া, প্রায় অচল হওয়া, অক্ষম হওয়া, একলা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মোট কথা ইয়াতীম হচ্ছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পিতৃহীন বালক-বালিকা। আর এই ইয়াতীমের সময়সীমা শেষ হয়ে যায় প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনে মোট ১০টি সূরার ২০টি আয়াতে ইয়াতীমদের সর্ম্পকে বলা হয়েছে। এখানে মাত্র কয়েকটি আয়াতের অর্থ প্রকাশ করা হলো।
১. সে এমন ঐ লোক যে ইয়াতীমদেরকে রূঢ় ভাষায় তাড়িয়ে দেয়, অর্থাৎ তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাকে কঠোর ভাষায় তাড়িয়ে দেয়। (আয়াত-২, সূরা আল-মাউন)।
২. তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম অবস্থায় পাননি? আর্থাৎ তিনি অবশ্যই আপনাকে এমন অবস্থায় পেয়েছেন যে, আপনি জন্মের পূর্বে বা পরে আপনার পিতাকে হারিয়েছেন। আর তিনি কি আপনাকে আপনার চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে আশ্রয় দেননি? (আয়াত-৬, সূরা আদ-দোহা)।
৩. (হে অভিভাবকগণ!) ইয়াতীমদেরকে (সময়মত) তাদের ধনসম্পত্তি দিয়ে দাও। আর ভালো মালের সাথে খারাপ মাল রদবদল করোনা এবং নিজেদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ সংমিশ্রিত করে অন্যায় ভাবে গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা গুরুতর অপরাধ।
আর যদি তোমরা আশংকা কর যে, ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে তাদেরকে বিয়ে না করে অন্য স্ত্রীলোকদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দমত দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার জনকে বিবাহ কর। কিন্তু যদি এ আশংকা কর যে, তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজন স্ত্রীই গ্রহণ কর অথবা তোমাদের অধীনস্ত দাসীকে বিবাহ কর। অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার এটাই খুব নিকটবর্তী পন্থা। 
আর আল্লাহ তোমাদেরকে ইয়াতীমের মালামাল তত্ত্ববধানের দায়িত্ব প্রদান করেছেন সেগুলো নির্বোধ ইয়াতীমদেরকে বুঝিয়ে দিও না। তবে তা হতে তাদের ভরণ-পোষণ চালাতে থাক এবং তাদের সাথে ন্যাংয়সংগত কথা বল। 
আর তোমরা ইয়াতীমদের পরীক্ষা করতে থাক যে পর্যন্ত না তারা বিবাহের বয়সে উপনীত হয়। অত:পর তোমরা যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-জ্ঞান দেখতে পাও তবে তাদের ধন-সম্পদ তাদের হাতে তুলে দাও। আর তারা বড় হয়ে নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে নেবে, এ ভয়ে অপব্যয় ও তাড়াহুড়া করে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করো না। আর যে পৃষ্টপোষক ধনশালী সে যেন ইয়াতীমদের সম্পদ ভক্ষণ করা হতে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকে। আর যে গরীব সে ন্যায়সংগতভাবে ভোগ করতে পারে। তারপর তোমরা যখন ইয়াতীমদের ধনসম্প তাদের নিকট সর্মপন করবে, তখন অবশ্যই সাক্ষী রাখবে। বস্তুত: আল্লাহই হচ্ছেন হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে যথেষ্ট।
আর (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) বণ্টনকালে সেখানে যদি (উত্তরাধিকারী নয় এমন) আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও নি:স্ব ব্যক্তিগণ উপস্থিত হয়, তবে ঐ সম্পত্তি হতে তাদেরকে কিছু দিয়ে দাও এবং তাদের সাথে সদয়ভাবে কথা বলো।
যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের সম্পদ গ্রাস করে, তারা মূলত: আগুন দ্বারাই নিজেদের পেট ভর্তি করে। অনতিবিলম্বেই তারা জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। (আয়াত- ২, ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, সূরা নিসা)।
৪. (হে মুমিগণ!) আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমরা যা কিছু গণীমতের মাল হিসেবে লাভ করে থাক তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ তায়ালা, তার রাসূল এবং রাসূলের নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকিন ও গরীব মুসাফিরদের জন্য। (এ নিয়ম তোমরা মেনে চলবে) যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালার প্রতি এবং চূড়ান্ত ফয়সালার দিন যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান এনে থাক, যেদিন (বদরযুদ্ধে) উভয় দল (মুসলিম ও কাফির) পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল। আর আল্লাহ তায়ালা সব জিনিসের উপর ক্ষমতাবান। (আয়াত- ৪১, সূরা আনফাল)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো ছাড়াও হাদীস শরীফে ইয়াতীমদের হক সম্পর্ক বলা হয়েছেÑ
১. হযরত আবু হুরাইয়া (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা:) এরশাদ করেছন, যে ঘরে ইয়াতীম রয়েছে এবং তাকে উত্তমভাবে লালন পালন করা হয়, সে ঘর সবচেয়ে উত্তম ঘর। আর যে ঘরে ইয়াতীম রয়েছে এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয় সে ঘর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘর। (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
২. আবু শুরাইহ খুরাইলিদ ইবনে আমার আল খুযাঈ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা:) বলেছেন, হে আল্লাহ! দুই দুর্বল অর্থাৎ ইয়াতীম ও নারীদের প্রাপ্য অধিকার যে ব্যক্তি নষ্ট করে আমি তার জন্য অন্যায় ও গুনাহ নির্দিষ্ট করে দিলাম। (রিয়াদুস সালেহীন।)
এছাড়াও আরো অসংখ্য হাদীসে ইয়াতীমদের সর্ম্পকে বলা হয়েছে। কুরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইয়াতীমদের কথা বার বার হয়েছে। নবী করিম (সা:) নিজে একজন ইয়াতীম ছিলেন। তাই তিনি ইয়াতীমদেরকে খুব বেশী ভালোবাসতেন। ইয়াতীমদের প্রসঙ্গে একটি ঘটনা আছে যা সংক্ষেপে এখানে প্রকাশ করা হল। 
আবু জাহেল একটি নাবালক ইয়াতীম ছেলের অভিভাবক ছিলেন। একদিন ইয়াতীম ছেলেটি তার পিতার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তাকে কিছু দেয়ার জন্যে অনুরোধ করল। কিন্তু আবু জাহেল তার কথায় কোন কান না দিয়ে বরং তার সাথে ঠাট্টা করতে লাগল। এতে ইয়াতীম বালকটি খুব কষ্ট পেল। পরিশেষে ছেলেটি রাসূল (সা:) এর নিকট এসে তার দু:খের কথা বললো, তার এই কষ্টের কথা শুনে নবী করিম (সা:) মর্মাহত হলেন এবং তার শত্রু আবু জাহেলের কাছে গেলেন। তিনি বললেন, হে আবু জাহেল এ ছেলেটির প্রাপ্য হক ফিরিয়ে দাও। অমনি আবু জাহেল তার পাপ্য সম্পদ ফিরিয়ে দিল। এ ঘটনা দেখে আবু জাহেলের সাথীরা অবাক হয়ে গেল এবং তারা বলতে লাগল, তুমি যে দেখছি মুহাম্মদ (সা:) এর কথায় উঠ বস। আবু জাহেল জবাব দিল, আমি তাঁর কথা শুনতাম না, কিন্তু আমি দেখতে পেলাম মুহাম্মদ (সা:) এর চারপাশে একটি বাঘ হা করে তাকিয়ে আছে মনে হয় যেন আমাকে খেয়ে ফেলবে। তাই আমি তাঁর কথায় রাজী হয়ে গেলাম। 
উপরোক্ত ঘটনা থেকেও আমরা জানতে পেলাম ইয়াতীমদের অধিকার কত কৌশলে আদায় করা হয়েছে। তাই ভাইয়েরা আসুন আমরা ইয়াতীম অসহায়দের ভালোবাসি। আর আমরা যারা সবল হয়ে ইয়াতীমদের অর্থ সম্পদ কেড়ে নিচ্ছি, তাদের প্রতি অমানসিক নির্যাতন চালাচ্ছি তারা যেন তাদের প্রতি সহায় হই। তা না হলে এর জন্যে আপনার, আমার সকলের মহান প্রভুর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। 

প্রকাশকাল: বুধবার, ২১ জুলাই ২০০৪ইং

কোন মন্তব্য নেই: