মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

বৃদ্ধাশ্রম থেকে ছেলের কাছে বাবার চিঠি

খোকা তুই কেমন আছিস? নিশ্চয়ই ভালো আছিস। আমি জানি এ চিঠি পড়ার মতো সময় তোর হবে না। তবুও বাবার মন না লিখে পারলাম না। কারণ তুই এখন অনেক বড় পদে চাকরি করছিস। ৫ বছর হয়ে গেছে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছিস; কিন্তু একটি বারও আমাকে দেখতে আসলি না। জানি ব্যস্ততার কারণে হয়তো সময় পাচ্ছিস না। আমি অনেক চিঠি লিখে তোর কাছে পাঠিয়েছি। এই ডিজিটাল যুগে হয়তো সেগুলো তোর কাছে পৌঁছলেও পড়ার মতো মানসিকতা ও সময় তোর হয়নি। কারণ আমি স্বল্পশিক্ষিত, গরিব এক সাধারণ মানুষ। তুই যেদিন বিয়ে করে বড় লোকের মেয়ে ঘরে নিয়ে আসলি সেদিন তোর বউ আমাকে গরিব বলে সম্মান জানায়নি। অথচ আমি গরিব হলেও আমার একটি পরিচয় আছে, আমি তোর বাবা। শুধুই তোর বাবা। আমারতো আর কোন ছেলে নেই।
জানিস খোকা তোর মা যখন মারা যায় তখন তোর বয়স ছিলো ৫ বছর। আর আমার বয়স তখন ৩৫ বছর। আমি তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম তোর মা যদি আগে মরে যায় তাহলে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করবো না। কারণ দ্বিতীয় বিয়ে করলে তোর কষ্ট হবে সেটা আমি যেমন উপলব্ধি করতাম তেমনি তোর মাও উপলব্ধি করতো। তাইতো আমি তোকে বুকে আগলিয়ে ধরে তোর মায়ের ভালোবাসায় তপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। তোর দাদা অনেক চেষ্টা করেছিলো আমাকে বিয়ে করাতে কিন্তু আমি রাজি হইনি শুধু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি যদি বিয়ে করি তাহলে তুই কষ্ট পাবি। সৎমা তোকে ঠিকমত আদর যত্ম করবে না। আবার অন্য সন্তান আসলে তোর প্রতি আমার মায়া কমে যাবে।
অভাবের সংসারে হাজারো বাঁধা বিপত্তি পাড়ি দিয়ে তোকে মানুষ করিয়েছি। তোর লেখা পড়ার খরচ চালাতে গিয়ে আমি অনেকবার না খেয়ে থেকেছি। একবারও তোকে বুঝতে দিইনি। তুই যখন উচ্চশিক্ষার জন্যে আমাকে ছেড়ে শহরে গিয়েছিলি সেদিন থেকে তুই বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত ভালো কোন খাবারের স্বাদ নিতাম না। তোকে ছাড়া আমার শূন্যতার শেষ ছিলো না। কিছুতেই সময় কাটতো না। কখন তুই ফিরে আসবি সেই অপেক্ষায় থাকতাম। খোকা তোর কি মনে আছে তুই খুব শুটকির ভর্তা পছন্দ করতি। এটা তোর প্রিয় ছিল। এখন মনে হয় ওটা আর প্রিয় নয়। কারণ তোর বউতো শুটকির ভর্তা পছন্দ করে না। তোর কি মনে আছে তুই যখন আলাদা বিছানায় শুইতে শিখলি, তখন থেকে প্রতিদিন গভীর রাতে একবার তোকে দেখে আসতাম। শীতে শরীর থেকে কাঁথা পড়ে গেলে ঠিক করে দিতাম। গরমের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে তোর পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম। এ ধরনের আরও বহু মধুর ও কষ্টের স্মৃতি আমাকে এখন শুধু কাঁদায়। এগুলো তোর হয়তো মনে নেই, আর মনে থাকার কথাও নয়। কারণ তুই এখন মস্ত বড় অফিসার!
খোকা আমাকে তোর বাড়িতে রাখলে তোদের কি খুবই কষ্ট হতো? আমি তোর বাড়ির চাকরের ঘরে থাকতে চেয়েছিলাম। তোরা চাকরের পেছনেতো খরচ করে থাকিস। তোর বউয়ের সেবা যত্ন করার জন্যে চাকরানি আছে। তার পেছনেও খরচ করে থাকিস। তোর বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্যে একটি কুকুর আছে। সেটার পেছনেওতো খরচ করিস। তারা খেয়ে যেটুকু বেঁচে যেত সেটুকু না হয় আমাকে খাওয়াতি। তবুওতো আমি শুধু তোর বাড়িতে থাকতে চেয়েছিলাম। এই বৃদ্ধ বয়সে ছেলে, বউমা ও নাতি নাতনিদেরকে নিয়ে সুখে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোরা আমাকে বাড়িতে থাকতে দিলি না। আমি বাড়িতে থাকলে তোদের ইজ্জত যাবে। তোর বউয়ের কথামতো আমাকে বাড়ি থেকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলি। তারপরও আমার মনে কোন দু:খ থাকত না যদি একবার আমাকে দেখতে আসতি।
আমি বিশ্বাস করি, মা-বাবার দোয়া সন্তানের প্রতি থাকলে কেউ তার অনিষ্ট করতে পারে না। নিশ্চয় স্ত্রী পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখে আছিস। তুই সুখে থাকলে পৃথিবীর যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো সে তোর মা। অনেকদিন যাবত তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমিতো আর যেতে পারি না। বাড়ি থেকে আসার সময় তোর একটি পুরানো ছবি এনেছিলাম। সেই ছবি দেখতে দেখতে ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে তোর বাবার হৃদয়ের সবটা জুড়ে শুধু তোর ছবি অঙ্কন করা। তারপরেও খুব ইচ্ছা করে, শেষ যাত্রার আগে তোকে একটি বার দেখতে, তোর মাথায় হাত রাখতে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এটা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে
খোকা কেমন আছিস? আরো ইচ্ছে করে আমার দাদু ও দাদা ভাইকে দেখতে। তারা নিশ্চয় দাদার কথা স্মরণ করে কান্নাকাটি করে। তাদেরকে বলিস আমি ভালো আছি।
সন্তানের জন্য কোন বাবা-মাই বদদোয়া করে না। আমিও করব না। তবে তোকে আমার কাছাকাছি রাখতে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। আল্লাহ যেন আমাকে একশ বছর বাঁচিয়ে রাখে। কারণ বর্তমানে তোর বয়স এখন ৩৫ বছর আর আমার বয়স ৬৫ বছর। তোর ছেলের বয়স ৫ বছর। পঁচিশ বছর পরে তোর হবে ষাট বছর। আমার বৃদ্ধাশ্রমের এই ঘরটায় জায়গা অনেক বেশি। তুই আর আমি থাকতে পারবো পাশাপাশি।


ইতি
তোর বাবা


১৫/০৩/২০১৭

কোন মন্তব্য নেই: