বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

বোমা হামলাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে

১৭ আগস্ট ২০০৫ রোজ বুধবার। প্রতিদিনের মতো আজও পূর্ব আকাশে সূর্য উদয়ের মধ্য দিয়ে দিন শুরু হলো। আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে লাগল। মানুষ যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ স্কুল, কলেজে গেল। কেউ অফিসে গেল। কেউ এ মুহূর্তে আর ঘরে বসে নেই। আমিও অন্যান্য দিনের মত কলেজে গেলাম। বেলা ১১টার দিকে আমরা কয়েকজন বন্ধু নরসিংদী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।
১১.৪ মিনিটে আমি কলেজ থেকে বের হয়ে স্টেশনের দিকে যাই। সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম নরসিংদী জজকোর্ট এলাকায় পরপর দুটো বোমা বিস্ফোরিত হয়। তার কিছুক্ষণ পর নরসিংদী জেলখানার পাশে একটি, নরসিংদী পুলিশ লাইন অজুখানায় একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। আরও কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম নরসিংদী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষের রুমের সামনে ঠিক যেখানে আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সেখানে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ৬ জন আহত হয়। এর মধ্যে মারাত্মক আহত হয় ঝনুফা নামক এক ছাত্রী। নরসিংদীতে সর্বশেষ বোমাটি বিস্ফোরিত হয় বাসস্টেশনে। এ নিয়ে মোট ছয়টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। টেলিভিশনে সংবাদে শুনতে পেলাম সারাদেশে বেলা ১১টা থেকে ১১.৩০ মিনিটের মধ্যে এক যুগে একমাত্র মুন্সীগঞ্জ ব্যতিত ৬৩টি জেলাতে ৪৬২টি টাইম বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। মিনিটে প্রায় ৮ টি বোমা বিস্ফোরণ হয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোথাও এ ধরনের নজিরবিহীন বোমা হামলা হয়নি। যা একমাত্র বাংলাদেশে হলো। এত বড় হামলায় শিশুসহ মাত্র দু’জন প্রাণ হারায়। আহত হয়েছে ২০০ এর মত। বোমার লক্ষ্যস্থল ছিল প্রশাসনিক ভবন, কলেজ ও আদালত পাড়া। ছোট বোমা ব্যবহার করায় এবং জনবহুল স্থানে তা না ফাটানোর দরুণ বিপুল প্রাণহানি ঘটেনি। তাই বলে একে খাটো করে দেখা যাবে না। আমার মনে হয় এ হামলার উদ্দেশ্য প্রাণহানি নয়, জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কের অধ্যায় রচিত হয়েছে। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। এ ঘটনা আমাদের জন্য এক ভয়াবহ বিপদের বার্তা নিয়ে আসছে। যারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা নিশ্চয় কোন ক্ষুদ্র শক্তি নয়, বৃহৎ শক্তি। তারা এর চেয়েও বড় ঘটনা ঘটাতে পারতো। রক্তের বন্যা বয়ে দিতে পারতো সারা দেশে। প্রায় প্রতিটি বোমার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিনের লিফলেট পাওয়া গেছে। এই লিফলেট নাকি প্রমাণ করে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে সরকারকে তদন্তের মাধ্যমে এ রহস্য উদঘাটন করতে হবে এবং অপরাধীদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে যাতে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়।
আমার মনে হয় যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায় তারা কখনো নিজের নামে লিফলেট ছাপাবে না। এটা এক ধরনের বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনও হতে পারে যারা ইসলামকে দেখতে পারে না, তারা ইসলামী শক্তিকে ফাঁসাতে জামায়াতুল মুজাহিদিনের নামে লিফলেট ছড়িয়েছে। তাই শুধু লিফলেট দেখেই তাদেরকে দোষারুপ করা যাবে না। সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। যারা এ কাজটি করেছে তারা মূলত দেশকে অস্থিতিশীল করে বিশ্বের কাছে হেয় করা, দেশের ইসলামী দলগুলোকে বিপদে ঠেলে দেয়া এবং সর্বোপরি বর্তমান সরকারকে বিশ্বের কাছে অকার্যকর হিসেবে তুলে ধরা এর উদ্দেশ্য। এ হামলায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগ। কারণ বহুদিন যাবত তারা হরতাল করার কোন ইস্যু খুঁজে পাচ্ছে না। তাই এ সুযোগে দেশকে হরতাল দিয়ে পঙ্গু করার ইস্যু খুঁজে পেয়েছে আওয়ামীলীগ।
আমাদের দেশে যে ক্ষুদ্র চরমপন্থি ইসলামী গ্রুপগুলো আছে তারা সাংগঠনিকভাবে তেমন সক্রিয় নয়। তারা দেশব্যাপী সাংগঠনিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ এখনও পুরোপুরি প্রদর্শন করতে পারেনি। তাদের আকারও তেমন বড় নয়। জামায়াতুল মুজাহিদিন তেমন একটি ক্ষুদ্র সংগঠন। এ ক্ষুদ্র সংগঠনটির দ্বারা এত বড় একটি ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দেয়া কিছুতেই সম্ভব না। সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা করার মতো এতলোক তাদের নেই। নিশ্চয় এখানে আন্তর্জাতিক শক্তি কাজ করছে। আমাদের দেশকে মৌলবাদী, তালেবান রাষ্ট্র বানানোর জন্য এ কাজটি করা হয়েছে।
একটি ব্যাপারে আমাদের আশ্চর্য হতে হয় যে, যখনই দেশে কোন ঘটনা ঘটে তখনই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি তাদের স্বভাবসুলভ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা থেকে শুরু করে আহমাদিয়াদের মসজিদ, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠান, সিপিবির সমাবেশে, গির্জায়, সিলেটে শাহজালালের মাজার, ২১ আগস্ট ২০০৪ আওয়ামীলগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়ে ১৭ আগস্টের বোমা হামলা পর্যন্ত যতগুলো বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা ঘটার সাথে সাথে দুই প্রধান দল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের তীর ছুঁড়ে মেরেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ দায়ী করছে ক্ষমতাসীন জোট সরকারকে আর বিএনপি দায়ী করছে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগকে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, “জামায়াতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বোমা হামলা চালানো হয়েছে।”
আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে, যেকোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রতি পক্ষদলকে সরাসরি গ্যারান্টিসহকারে দোষারোপ করে ফেলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তা করতে পারেন না। আকার ইঙ্গিতে বুঝায় যে প্রতিপক্ষ দলই এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এসব বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে সব সময় সরকারি দল বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। আর প্রধান বিরোধী দল হরতাল দিয়ে বাস, ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নিরীহ মানুষদেরকে মেরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করে। এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যতনা প্রাণহানি ঘটে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানী ঘটানো হয় হরতাল কর্মসূচী পালন করে। এই হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত পরিচয়। আর এভাবে যখন দু’দল অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ করে দেশকে মাতিয়ে তুলে তখন এ সুযোগে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। শুধু তাই নয় এ অপশক্তিগুলো আরো শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পায়। অথচ একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার সাথে সাথে সরকারের উচিত ছিল সুষ্ঠু তদন্ত করে এর বিচার করা এবং বিরোধী দলের উচিত ছিল এ কাজে সরকারকে সহযোগিতা করা। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। নিরীহ মানুষ মরলে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। তারা সারাক্ষণ শুধু প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কে কাকে ঘায়েল করে উপরে উঠতে পারবে সে ধান্ধায় সারাক্ষণ ব্যস্ত। তাদের এহেন আচরণে দেশ আজ পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ নিরাপদে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। তারা আজ সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না।
পরিশেষে আমি বলব, এমন সংকটময় মুহূর্তে দু’দলের উচিত পাল্টাপাল্টি অভিযোগ না করে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর প্রকৃত অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

প্রকাশকাল: বুধবার, ২৪ আগস্ট ২০০৫ইং

কোন মন্তব্য নেই: