বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

পতিতাবৃত্তিকে রোধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে

পতিতাবৃত্তির মতো একটি নিকৃষ্ট পেশা আমাদের সমাজে আজ গেড়ে বসেছে। এই পেশার সাথে জড়িয়ে কত নারী যে তাদের জীবনে ধ্বংস ডেকে এনেছে, কত পুরুষ যে সহায় সম্বল হারিয়েছে পতিতালয়ে গমন করে তার কোন ইয়ত্তা নেই। মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে কত নারী-পুরুষ। যুব সমাজের ধ্বংসের মূল অধ:পতন হলো এই পতিতালয়। অনেকে পতিতালয়কে ভাল চোখে দেখেন। তাদের ধারনা পতিতালয় আছে বলেই অনেক যুবক বিভিন্ন অপরাধ থেকে বেঁচে আছে। যেমন ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ তাদের দ্বারা
হয় না, যারা নিয়মিত পতিতালয়ে গমন করে। হ্যাঁ সব কিছুরই ভাল মন্দ মন্দ দুটো দিক আছে। তবে আমাদেরকে দেখতে হবে কোন দিকটা বেশী ভাল। ভাল দিক বেশী হলে সেদিকে আমাদেরকে ঝুঁকতে হবে। আর মন্দ দিক বেশি হলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। পতিতালয়ের কিন্তু ভালোর চেয়ে খারাপ দিকই বেশী। পতিতালয়ে গমন করে অনেক নারী-পুরুষ এইডস এর মতো ভয়াবহ মরণব্যাধি ডেকে আনছে। এক শ্রেণীর অর্থ লিপ্সু পুরুষরা নারীদের নিয়ে পতিতালয় তৈরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করছে। তারা নারীদেরকে এ পথে এনে পরিবার, সংসার থেকে সরিয়ে রাখছে। আমাদের সমাজে দিন দিন পতিতালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব। জনগণ এর বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করছে না। তাইতো তারা মদদ পেয়ে নারীদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, যুবকদের ধ্বংস করার জন্য এ ব্যবসা করছে।
অনেকে হয়তো পতিতা ও পতিতালয় কি তাও জানেনা। যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, পতিতা বলতে বুঝায় সেই মহিলাকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে যে কোন ব্যক্তিকে যৌন সর্ম্পকের জন্য তার দেহ দান করে। সহজ কথায় বলা যায় অর্থ সম্পদের বিনিময়ে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জীবন ধারনের উপায় হলো পতিতা বা পতিতাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি বা গণিকাবৃত্তি। আর যেখানে এই অবৈধ যৌন কার্য সম্পাদন করা হয় সে জায়গাকে বলে পতিতালয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে পতিতালয় একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাধারণত এটি শহরে বেশী লক্ষ্য করা যায়। মূলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অর্থ লিপসু দুশ্চরিত্রের লোকের দ্বারা পতিতালয় গড়ে উঠে। আর এইসব পতিতালয়ে এসে নারীরা বঞ্চিত হয় একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পারিবারিক তথা সমাজ জীবন থেকে। খদ্দের হারায় সম্পদ, অর্থ ও পারিবারিক শান্তি। পতিতাবৃত্তি খদ্দের ও নারীর উভয়ে নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। উভয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ যৌন আনন্দ লাভে হয় বঞ্চিত। বস্তুতঃ পতিতাবৃত্তি যৌন বিকৃতিরই নামান্তর। পতিতাবৃত্তির কারণে উভয়ের বংশধরদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হতে পারে। সমাজের সবাই এই পেশাকে খারাপ চোখে দেখে। এটাকে কেন্দ্র করে সামাজিক তথা অপরাধমূলক আচরণ দেখা যায়। মাদকাসক্তি, মাতলামি, জুয়াখেলা, ব্লু-ফ্লিম, ধর্ষণ, ইভটিজিং ইত্যাদি অপরাধ করতে থাকে তারা।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের পতিতালয় দেখা যায়। যেমন-
(১) পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তি: নির্দিষ্ট এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পতিতালয় তৈরি করে অবাধ যৌন মিলন করে এখানে। এখানে টাকার বিনিময়ে খদ্দেররা টিকেট কেটে ঢুকে। এক ঘন্টা/দুই ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশী সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে মেয়েদের সাথে যৌন মিলন করে।
(২) ভাসমান পতিতাবৃত্তি: এরা রেল স্টেশন মোড়ে বা বিভিন্ন চিপা গলিতে রাতের অন্ধকারে খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকে। যখন কোন খদ্দেরের সন্ধান পায় তখন তারা টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌনকার্য সম্পাদন করে।
(৩) হোটেলে পতিতাবৃত্তি: বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে সুন্দরী নারীদেরকে রাখা হয়। ভাড়াটেদের প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের সাথে থাকতে দেয়া হয়। সারারাত ঐ নারীর সাথে যৌন মিলন করে আনন্দ উপভোগ করে।
(৪) ভাড়া বাড়িতে পতিতাবৃত্তি: অনেক জায়গায় আবার বিভিন্ন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পতিতারা বসবাস করে। সারাদিন খদ্দেরের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরা করে। যখন কোন খদ্দেরের সন্ধান পায় তখন তাকে রাতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করে। টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দিনের পর দিন এখানে এসে রাত্রি যাপন করে যৌন মিলন করে।
এখন আমাদেরকে ভেবে দেখা দরকার কেন এসব মেয়েরা পতিতাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট পেশা বেছে নিচ্ছে। যেমন-
(১) দারিদ্রতা আমাদের সমাজের অন্যতম প্রধান কারণ। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক যুবতী নারী ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় পতিলয়ের মতো এহেন অমানবিক তথা অনৈতিক পেশায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রামের দরিদ্র মেয়েরা শহরে এসে পতিতালয়ের আশ্রয় নেয়। গ্রামীণ সমাজের দারিদ্র দশাই নারীদের একটি অংশকে নগরে ঠেলে দিচ্ছে, যারা সেচ্ছায় অথবা দালালের খপ্পরে পড়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে।
(২) অনেকে আবার জরায়ুর স্বাধীনতার জন্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। তারা একই স্বামীর সঙ্গে সারাজীবন বসবাস করতে নারাজ। তাছাড়া সাংসারিক ঝামেলা, সন্তান সন্তুতি লালন-পালন ইত্যাদি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
(৩) অনেক দুশ্চরিত্র মেয়েরা এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। কারণ এখানে শারিরীক আনন্দ ও অর্থ দুটোই পাওয়া যায়। যা অন্য কোন পেশায় সম্ভব নয়। তাছাড়া একাধিক পুরুষের সাথে যৌন মিলন করে জীবনকে অন্য রকমভাবে উপভোগ করার স্বাদও এ পেশায় পাওয়া যায়।
(৪) স্বামী-স্ত্রীর পৃথক বা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে অনেক নারী এ পেশায় এসে স্বামীদের বুঝিয়ে দেয় তোমাদেরকে ছাড়াও আমরা জীবন যাপন করতে পারি।
(৫) অনেক নারী প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এ পথে পা বাড়ায়। জীবনে বিয়ে না করার পরিকল্পনা করে এ পেশায় নিয়োজিত হয়।
(৬) অবিবাহিত নারীরা যৌন চাহিদা মেটাবার জন্য এ পেশায় আসে।
(৭) এ পেশায় আসার জন্য ধর্ষণকেও দায়ী করা যায়। অনেক ধর্ষিতা নারী আছে যারা সমাজে স্থান পায় না। ধর্ষিতা হওয়ার কারণে যখন বিয়ে হয়না তখন তারা বাধ্য হয়ে পতিতালয়ে আসে।
(৮) দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে এ পেশায় চলে আসে। প্রথমে তারা বুঝতে পারেনা কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন ইচ্ছে করেও এ পথ থেকে ফিরে আসতে পারে না। সাধারণত গ্রামের সহজ সরল মেয়েদেরকে শহরে চাকুরী দেয়ার নাম করে ফুসলিয়ে এনে পতিতালয়ে তাদেরকে ভাড়া খাটায় বা বিক্রি করে দেয়। তখন তাদেরকে মাসিক বড় অঙ্কের একটা বেতনও দেওয়া হয়। আর এই অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে বাড়িতে পাঠায়। অভিভাবকরা মনে করে তাদের মেয়ে সত্যিই চাকরি করে টাকা পাঠাচ্ছে।
(৯) এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। পুঁজি লাগে না। পুঁিজবিহীন ব্যবসা করতে অনেক মহিলা আগ্রহী। আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর নারী জীবনের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে পতিতালয়কে পেশা হিসেবে বেঁচে নেয়। একজন পতিতা মাসে ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করে। যা বাংলাদেশের জাতীয় বেতন স্কেলের মাপকাঠি থেকে বেশ লাভজনক।
(১০) এ পেশায় আসার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রীর প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণত রূপ, যৌবন থাকলেই চলে। তাছাড়া বর্তমানে চাকরী নামক সোনার হরিণের পিছনে ঘোরাঘুরি না করে এ পেশায় আসা সহজ।
(১১) জন্মগত কারণে অনেক নারী পতিতালয়ে গমন করে। সাধারণত পতিতার মেয়েই পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
এছাড়াও আরো আরো অনেক কারণ আছে যার জন্য একজন নারী এ পেশায় আসতে পারে। আর নারী এ পেশায় আসার ফলে পুরুষরা খদ্দের হয়ে তাদের কাছে যায়। বিভিন্ন কারণে পুরুষরা খদ্দের হয়ে পতিতালয়ে আসে। তমধ্যে অবিবাহিত যুবকরাই বেশী। যেমন-
(১) অবিবাহিত পুরুষদের মধ্যে যেসব পুরুষের যৌন চাহিদা বেশী তারা যৌন চাহিদা মেটাবার জন্য পতিতালয়ে যায়।
(২) অনেক বিবাহিত পুরুষও পতিতালয়ে যায়। অনেক পুরুষ স্ত্রীর ঘ্যানর ঘ্যানর প্যানর প্যানর সহ্য করতে না পেরে এ পথে পা বাড়ায়। অনেক নারী স্বামীর অবাধ্য হয়ে বিভিন্ন খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। তখন স্বামী মনের জ্বালা ও ক্ষোভ মেটাবার জন্য পতিতালয়ে গমন করে।
(৩) অনেকের স্ত্রী দুটা বা একটা সন্তান রেখে মারা যায়। তখন স্বামী স্ত্রীকে যে কত ভালোবাসে তা দেখানোর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করে না বা সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করে না। কিন্তু যৌন জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যৌন চাহিদা মেটাবার জন্য পতিতালয়ে গমন করে।
(৪) অনেক যুবক প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিয়ে না করার সংকল্প করে কিন্তু যৌন জ্বালা মেটানোর জন্য পতিতালয়ে গমন করে।
তাছাড়াও আরো অনেক কারণে একজন পুরুষ পতিতালয়ে গমন করে থাকতে পারে।
উপরোক্ত কারণগুলোর কারণে যাতে কোন নারী এ পথে পা রাখতে না পারে সেদিকে প্রতিটা পরিবারের সজাগ থাকতে হবে। সকল ধর্মের দৃষ্টিতেই এটা অন্যায়। তাই এই পতিতা বা বেশ্যাবৃত্তিকে রোধ করতে হলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিকভাবে সকলে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আশা করা যায় বেশ্যাবৃত্তিকে সমাজ থেকে ধ্বংস করা যাবে।

প্রকাশকাল: বুধবার, ৬ জুলাই ২০০৫ইং

কোন মন্তব্য নেই: