শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১৬

অপরূপ মাধবকুণ্ড

নেট থেকে সংগ্রহ করা ছবি
ঝর্ণাকে নাকি পাহাড়ের কান্না বলে। সেই কান্না আবার মানুষকে আনন্দ দেই তা মাধবকুণ্ডে না গেলে বুঝতে পারতাম না। মহান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে গড়া এই ঝর্ণাকে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। হবেই না কেন? কারণ পাহাড়ে গা ফুঁড়ে অঝোর ধারায় সাঁ সাঁ শব্দে নেমে আসছে পানি। অসংখ্য জলকণার মিলন মেলায় সৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গীত। বাতাসে সেই সঙ্গীতের সুর উঠা নামা করছে। এই সুরের মুর্ছনা শুনার জন্য সারা বছর দেশের অগুণিত দর্শক ছুটে আসছে এখানে। তাই আমরা কিছু ভ্রমণ প্রিয়াসী ছুটে গিয়েছিলাম সেই সঙ্গীতের সুরের মুর্ছনায় মুগ্ধ হওয়ার জন্য। বন্ধুদের মধ্যে ছিল প্রিয় বন্ধু আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ আরো অনেকে।
২০০৮ সালে নরসিংদী থেকে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখতে বাস ভাড়া করে রওয়ানা হলাম। মাধবকুণ্ড পৌছে জলপ্রপাত দেখার আগেই ঝর্ণার শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। দেখলাম পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা বিভিন্ন ধরনের গাছপালা সূর্যের পানে চেয়ে আছে। আর ডালে ডালে পাখির মিষ্টি মধুর গান। ছায়াঘেড়া পথে এ এক অসাধারণ অনুভূতি। গাড়ি থেকে নেমেই আমরা দ্রুত ছুটে গেলাম ঝর্ণার কাছে। এই প্রথম মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি ঝর্ণা দেখলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। তখন ভুলে গেলাম দীর্ঘ কান্তিকর ভ্রমণের কথা। আমরা সবাই আনন্দে অত্মহারা হয়ে গেলাম। পাহাড়ের নিচে স্বচ্ছ পানি দেখে সবাই নেমে পড়লাম গোসল করতে। তবে পানি খুব ঠাণ্ডা বলে বেশি সময় থাকতে পারিনি। আমরা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠলাম। ছুঁয়ে দেখলাম আল্লাহর কুদরত ঝর্ণাধারার পানি।
ঝর্ণার শীতল পানিতে গোসল করছেন লেখক
সবুজে আবৃত আর পাহাড়ে ঘেরা দেশের সর্ববৃহ মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতটি প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত। পাহাড় আর সবুজের সমারোহে ঘেরা এই জলপ্রপাতটি প্রকৃতির অপরূপ দান হিসেবেই মনে হয়েছে। মাধবকুণ্ডের সুউচ্চ পাহাড় শৃঙ্গ থেকে শুভ্র জলরাশি অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে। আর এই জলপ্রপাতের স্ফটিক জলরাশি দেখতে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগুনা পরিলক্ষিত হয়। ঝর্ণার শব্দ আর পাখির কলতানই এখানে কেবল নীরবতার ঘুম ভাঙ্গায়। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি পাহাড়ের গা বেয়ে সাঁ সাঁ শব্দে প্রবাহিত হয়ে নিচে আছড়ে পড়ছে। নিচে বিছানো পাথরের আঘাতে পানির ফোঁটা বাতাসে উড়ে তৈরি করছে কুয়াশা। আগে ঝর্ণার নিচে কোন পুকুর বা গর্ত ছিল না। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবত উপর থেকে পানি পড়তে থাকায় এখানে একটা পুকুরের মতো তৈরি হয়েছে। পতন মুখে অনেক পাথরও জমা হয়েছে। ঝর্ণার পানি নিচে পড়ে ছোট বড় পাথরের ফাঁক গলিয়ে মিশে যাচ্ছে একটি ছড়াতে গিয়ে। ঝর্ণার ঝিরি ঝিরি জলকনা চারিপাশের পরিবেশকে যেমন শীতল করে তেমনি সিক্ত করে প্রকৃতিকে। এমন দৃশ্য কেবল হয়তো কল্পনায় দেখা যায়। ঝর্ণার সম্মুখে বড় পাথরে বসে বসে আনমনে সে দৃশ্য দেখলে হয়তো স্বপ্ন ভেবে ভুল করতে পারেন।
কথিত আছে মাধকুণ্ড অতীত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। মাধবেশ্বরের আর্শিবাদ নিতে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রতি বছরের চৈত্র মাসে। এ সময় মধুকৃষ্ণা এয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী স্নান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন। মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গেরও পূজা হয়ে থাকে। চৈত্রমাসের ওই সময়ে বড় ধরনের মেলা বসে।
জলপ্রপাতের অবিরাম স্রোতধারা প্রবাহিত হওয়ায় পাহাড়ের শরীর পুরোটাই যেন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছে। জলরাশি নির্গত কুণ্ডে ডানদিকে রয়েছে বিশাল গুহা। আদিম যুগের মানুষ এই গুহায় বসবাস করলেও আধুনিক যুগের মানষু গুহার সাথে তেমন পরিচিত নয়। তবে মাধকুণ্ড এলে গুহার ভেতর প্রবেশ করে নতুন আমেজ পাওয়া যায়। আমারও সেই গুড়ায় প্রবেশ করে দেখলাম। পাহাড়ের গভীরে তৈরি গুহাকে আধুনিক কারুকচিত পাথরের একচালা মনে হয়ে থাকে। গুহাটির সৃষ্টি প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে বলে অনেকের ধারণা করলেও মূলত এটি ছিল সন্ন্যাসী মাধবেশ্বরের ধ্যান মগ্নের গোপন আস্তনা। এটি কিভাবে করা হয়েছে, কারা তৈরি করেছিল তার সঠিক তথ্য আজও রহস্যাবৃত। 
ঝর্ণার পানি ছুঁয়ে দেখার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে পাহাড়ে উঠছেন লেখক
মাধবকুণ্ডের নামকরণ সর্ম্পকে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ভূ-তাত্ত্বিকদের ধারনা প্রায় হাজার বছর আগে শ্রীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে সেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নিচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। পাহাড় বেশিষ্টত নির্জন স্থানে সন্ন্যাসী ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সন্ন্যাসীর নাম ছিল মাধবেশ্বর। মাধবেশ্বরের আস্থানা ঘেষে ছিল ঝর্ণাধারা। সেই ঝর্ণাধারার শীতল জল দিয়ে সন্ন্যাসী তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন তখন মাধবেশ্বরের পদবন্দনা ও স্তুতি করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশ দিতেন। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশ তীথিতে তাকে এ কুণ্ডে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মাধব, মাধব, মাধব নামে দৈববাণী হয়। সম্ভবত এ থেকেই মাধকুণ্ড নামেরে উপত্তি।
মাধকুণ্ড যাওয়ার পথে শুধু চা বাগান আর সবুজ অরণ্যই চোখে পড়ে। এইসব চা বাগান দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। চা বাগানে হেঁটে মনে হলো সবুজের দেশে চলে আসছি। মাধবকুণ্ডের চারপাশে বিশাল সব পাহাড় আর সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। পাখপাখালির ডাক আর ঝর্ণার পানি পড়ার মিষ্টি মধুর সুর ছেড়ে আসতে আমাদের মন চাইছে না। পাহাড় আর সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই পরিবেশ সত্যিই ভালো লাগে যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এসব কারণে পর্যটকরা বারবার ছুটে আসে মাধবকুণ্ডে। তারপরও মায়ার জালকে ছিন্ন করে চলে আসলাম মাধবকুণ্ড থেকে।  

তথ্যসূত্র: অনলাইন ও বিভিন্ন পত্রিকা

কোন মন্তব্য নেই: