রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

বাংলাদেশের নারী নির্যাতন

আমরা আজ প্রবেশ করেছি একবিংশ শতাব্দিতে। নতুন শতাব্দীতে কেমন আছে বাংলাদেশের নারীরা? এই প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা ভাল নেই। বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ ও নারী পাচারের মতো ঘটনা।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের চেয়ে ঢের বেশী নারী নির্যাতন হচ্ছে পথে, ঘাটে, গৃহে, কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীর করুণ চিত্র। বর্তমানে দেশের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা দুজনই নারী। কিন্তু এই নারীরা কি পেরেছে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে? পেরেছে কি ধর্ষণের সেঞ্চুরীর হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি এসিড নিক্ষেপের হাত থেকে আঁখির মতো অসহায় মেয়েদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে শিক্ষাঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করতে?
পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণ আমাদের সমাজে এক চরমতম সংকট ও মারাত্মক আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়ে তাদের কাছে ধর্ষণ শব্দটা বেশী পরিচিত। এমনকি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও ধর্ষণ শব্দটির সাথে পরিচিত। বর্তমানে পত্রিকা হাতে নিলে কিংবা টেলিভিশনের সংবাদ দেখলে প্রথমে ভেসে আসে ধর্ষণের লোমহর্ষক কাহিনী। পত্রিকার পাতায় এমন কোন দিন বাদ নেই যে ধর্ষণের খবর আসে না। পত্রিকার খবর ছাড়াও দেশের আনাচে কানাচে কত নারী যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার কোন হিসেব নেই। দেশের কোথাও না কোথাও ২ বছরের কন্যা শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষণের নেশায় কিছু মানুষরুপী নরপশুরা এসব নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে যা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। বর্তমানে এসব মানুষরূপী নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশু কন্যা, বৃদ্ধা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। আগে ধর্ষণ হতো গোপনে আর এখন ধর্ষণ হয় প্রকাশ্যে খোলা মাঠে, চলন্ত বাসের মধ্যে। যেখানে একজন নারীকে হাত পা বেঁধে দল বেধে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ কারীরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়না, ধর্ষণের পর খুন করা হয় ধর্ষিতাকে। মা-বাবার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এসব করেও ধর্ষকরা শান্তি পাচ্ছে না। তারা এখন ধর্ষণের দৃশ্যকে ভিডিও করে ব্লু-ফিল্ম বানিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে। ইদানিং ইন্টানেটেও ধর্ষণের ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে। যা জাহেলিয়াতের যুগকে হার মানাচ্ছে। জানি না এর পরের অবস্থা কি হবে। কি আছে নারী কপালে।
এছাড়াও বর্তমানে নারীরা পুরুষ কর্তৃক যত প্রকার নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যৌতুকের শিকার। বর্তমানে এ যৌতুক একটি প্রথা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা নারী সমাজের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের ফলে কত নারীর সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কত নারী যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই। যুগ যুগ ধরে এ যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। আজ যৌতুক নামক এ কু-প্রথাটি ক্রমান্বয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের নারীরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু যৌতুকসহ বিভিন্ন অশুভ সামাজিক প্রথা সামাজিকভাবে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত হবার পথে এখন প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। দেশে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যৌতুক প্রথার ফলে আজ নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। তারা আজ সমাজে মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে না। কাজেই এই মানবতা বিরোধী কু-প্রথার অচিরেই অবসান হওয়ার দরকার। তা না হলে এই বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র দেশে পরিবারে কখনও শান্তি আসবে না। নারী যাতে নিগৃহীত নিপীড়িত না হয় এ জন্য এ হীন যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে এখনই গণআন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার সরকার ও জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ। যৌতুকের ফলে অসহায় গরীব কন্যাদায়গ্রস্থ পিতারা পড়েন বেশী বিপদে। অনেক কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে দেখছি তার কন্যাকে বিয়ে দেয়ার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের হাত পাততে। এর চেয়ে লজ্জা একজন পিতার জন্য আর কি হতে পারে। এত কষ্ট, ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করেও একজন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা তার কন্যাকে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। কন্যার শশুর বাড়ি থেকে পুন: পুন: চাপ আসতে থাকে নতুন বাজেট পাস করার জন্য। বাপের বাড়ির লোকজন যদি নতুন বাজেট অনুমোদন করে তাহলে বউ খুব ভাল, লক্ষ্মী। আর যদি বাজেট অনুমোদন করতে দেড়ী হয় বা পাস না হয় তাহলে শুরু হয় নির্যাতন। বধুর প্রতিটি কথা স্বামী, শশুর-শাশুড়ির নিকট তেতো লাগে। এক সময় শুরু হয় ঐ অসহায় নারীটির প্রতি শারীরিক, মানসিক নির্যাতন। নির্যাতনের স্টিমরোলার এতই বর্বরোচিত ও নির্মম যে তা মুখে আনাও দুষ্কর। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, লাঠি দিয়ে আঘাত, এসিড নিক্ষেপ, ছুরিকাঘাত ইত্যাদি। তারপর নির্মমভাবে শ্বাসরোদ্ধ করে হত্যা। হত্যার পর ছুরি বা ব্লেট দিয়ে যৌনাঙ্গ, স্তন ক্ষত বিক্ষত করা, খুনের পর সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এমন খবরও সংবাদ পত্রের পাতায় উঠে আসে। এ ব্যাপারে যদি কন্যা পক্ষ থানায় মামলা করে তা নেয়া হয় না। কারণ ইতিমধ্যে থানা কর্তৃপক্ষের সাথে খুনীদের সমঝোতা হয়ে যায়। আর যদি মামলা নেয়া হয় তাহলে কন্যা পক্ষকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য জীবনাশের হুমকি দেয়া হয়।
সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে নারীর প্রতি এই মরণ এসিড নিক্ষেপ হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপের ফলে ঝলছে যায় আক্রান্ত নারীর শরীর। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষ এতোটা পাষাণ হয় কিভাবে? এর উত্তর আমার জানা নেই। আজ আমরা যে নারীকে এসিড নিক্ষেপ করছি আমাদেরও তো মা বোন আছে। তাহলে আমরা কেন এতটা নির্মম হয়। আমাদের বিবেক কি একবারের জন্যও নাড়া দেয় না? আজকে যাকে এসিড নিক্ষেপ করা হলো সে যদিও বেঁচে যায় তাহলে হয়তো এই ক্ষত নিয়ে সারা জীবন চলতে হবে। গত ১৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাজাধানীর বংশালের চানখারপুল এলাকায় শারমিন আক্তার আখি নামে ইডেন মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে জখম ও এসিড নিক্ষেপ করে মনির উদ্দিন নামের কথিত এক প্রেমিক। জানা গেছে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কথিত প্রেমিক মনির উদ্দিন এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলে এসিড নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে অনেক নারী বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বাজারের পণ্যের মতো নারীকে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই? পরিশেষে আমরা বলবো বর্তমান যুগে নারীদেরকে তাদের অধিকারের জন্য আরো সচেতন হতে হবে। বুঝে নিতে হবে তাদের হিসাব নিকাশ। পুরুষ শাসিত এই সমাজে তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। মুখ বুঝে সহ্য না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তাহলে নারী জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে।

রচনাকালঃ ১৬ অক্টোবর ২০১৪ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: