সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে
জীবনের প্রথম সমুদ্র ভ্রমণের সময় ঘনিয়ে এলো। ২০ নভেম্বর ২০০৫ সাল সকাল ৬টায়
কক্সবাজার হোটেল লেমিছ থেকে আমাদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৫২ জনের মধ্যে
নুরুল হুদা স্যারের পরিবার ছাড়া মোট ৪৯ জনের কাফেলা স্বপ্নের প্রবাল দ্বীপ
সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ৮:৩০ মিনিটে টেকনাফ সমুদ্র বন্দরে
এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে হালকা নাস্তা করে নিলাম। ৯টায় জাহাজ ‘খিজির-৬’ এ
উঠলাম। আমরা ৪৯জন ও অন্য ২জন যাত্রীসহ মোট ৫১জন যাত্রী নিয়ে সকাল ১০:০০টায়
জাহাজটি সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। ৪তলা এ
জাহাজে ১৮৬টি সিট
আছে। আমাদের সিটগুলো পড়েছিল তিন তলায়। কিন্তু কেউ সিটে বসে থাকিনি। সবাই
সমুদ্র ভ্রমণের আনন্দে হৈ চৈ করছে। কেউ নিচ তলায়, কেউ দু’তলায়, কেউ তৃতীয়
তলায় আবার কেউ বা ছাদে ছোটাছুটি করছে। কেউ রেলিং এ দাঁড়িয়ে জাহাজ কিভাবে
পানি কেটে সামনের দিকে যাচ্ছে সে দৃশ্য দেখছে। অনেকে পাহাড় সাগরকে সামনে
রেখে ছবি তুলছে। আমিও ছবি তুললাম। ছাদে বসেছে গানের আড্ডা। সাথে গল্প ও
কৌতুক পরিবেশ করা হচ্ছে। মোশারফ স্যার ও মান্নান স্যার আমাদের সাথে ছিলেন।
মান্নান স্যার মজার মজার গল্প ও কৌতুক বলে আমাদেরকে হাসাচ্ছেন। ঢেউয়ের তালে
তালে আর গল্পে উম্মাতাল হয়ে উঠল জাহাজের ছাদ। আমি ছাদে উঠে দেখলাম
টেকনাফের পাহাড়ী কুমারী নাফ নদীর উচ্ছ্বাসিত নৃত্য ও মায়ানমারের সীমান্ত।
উচুঁ-নিচু পাহাড় যেন আকাশের সাথে মিশে আছে। কিন্তু আশ্চর্য! এখানে সরল
রেখার মতো দাগ টেনে পানির দুটি ধারাকে বিভক্ত করা হয়েছে। একদিকে মিঠা পানি
আর এক দিকে লবণাক্ত পানি। ধীরে ধীরে নাফ নদীর মাঝ দিয়ে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে
আর একদল গাংচিল পাখি ধারালো চঞ্চু উচিয়ে আমাদের পিছু ধাওয়া করছিল। মনে হয়
যেন আমরা একদল চোরাকারবারী তারা কোস্ট গার্ড হিসেবে আমাদেরকে ধাওয়া করছে।
বেলা সাড়ে এগারটার দিকে জাহাজ যখন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করল তখন গাংচিলের দল
ফিরে গেল। তারা আর আমাদেরকে ধাওয়া করতে আসেনি। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেক
দূরে ঝাপসা বার্মার পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। পাহাড়গুলো যেন আকাশের সাথে
মিশে একাকার হয়ে গেছে। আর ডানে, সামনে, পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুধু
পানি আর পানি। পানি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। জাহাজ যখন বঙ্গোপসাগরের
মাঝামাঝি চলে আসল তখন দূরে ধূয়ার মত দেখা গেল। উপরে আকাশ, নীচে পানি। এ যেন
দুনিয়াব্যাপী এক গালিচা। ঐ সূদূর দিগন্তে সাগর আর আকাশ এমনভাবে মিশে
একাকার হয়ে গেছে, তাদেরকে আলাদা করা যাবে না। তাদের ভেতর এতই মিল যে আকাশের
নীল শাড়ীর সাথে ম্যাচ করে সাগরও যেন নীলাম্বরী সেজেছে। আমার মনে হয় আমরা
এক ফুটবলের ভেতর আছি। আশে পাশে আমাদের জাহাজটি ছাড়া আর কোন জাহাজ ছিল না।
এমন সময় একজন বলে উঠল, ঐ তো সামনে সেন্টমার্টিন দেখা যাচ্ছে। এ কথা বলার
সাথে উৎসুক সবাই সেন্টমার্টিনকে দূর থেকে দেখার চেষ্টা করলো। দূর থেকে
ঝাপসা দেখা যাচ্ছে কালো কালো গাছপালা। আর আমরা তখন সবাই অপেক্ষা করতে
লাগলাম কালো রেখার মতো চিক্ চিক স্বপ্নের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে
নামার জন্য।
[জাহাজের পিছনে দাঁড়ানো লেখক]
বাংলাদেশের সুন্দরতম অন্যতম দ্বীপের নাম
সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের
গভীরে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। টেকনাফ থেকে ৩৪ কিলোমিটার
দক্ষিণে এ দ্বীপ অবস্থিত। স্বচ্ছ নীল পানির বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে দ্বীপটির
কাছে যেতেই মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য নারিকেল গাছ মাথায় নিয়ে টাইটানিক জাহাজের
মত দ্বীপটি সাগরের লোনা পানিতে ভাসছে আর আকাশটারে কুলে করে রাখছে। নারিকেল
গাছের প্রাচুর্যের জন্য সেন্টমার্টিনের নাম দেয়া হয়েছিল নারিকেল জিঞ্জিরা।
জিঞ্জিরা মানে অপেক্ষার স্থান। এই দ্বীপটি ৮ কিলোমিটার। ভাটার সময় ৯
কিলোমিটার আর জোয়ারের সময় ৫ কিলোমিটার হয়। নীল সমুদ্রের ঢেউ দেখে চোখ
জুড়ানোর জন্য, পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর্যকে কাছে পাওয়ার জন্য, বিশাল আকাশকে
কাছে পাওয়ার জন্য এ সেন্টমার্টিন একান্তই দরকার। এখানে বসে এক সাথে
সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখা যায়। কালো কালো অজস্র প্রবালের মধ্যে যখন নীল
সাগরের ফেনা তোলা সাদা ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে তখন সে দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া যায়
না। প্রকৃতির অকৃপণ হাতে গড়া সত্যিই এক চমৎকার দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর
যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু বৈচিত্র আর বৈচিত্র।
দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা সমুদ্র ভ্রমণ করে অবশেষে
১২:৩০ মিনিটে যখন সেন্টমার্টিনের জেটিতে পা রাখলাম তখন দেখলাম অনিন্দ্য
সুন্দর ঝকঝকে বাক খাওয়া এক স্বর্ণাভ বালির সৈকত। ফুটন্ত রূপের মত সাগরের
ঢেউ এসে ভেঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে তাতে। উপরে বাজার। তার পাশে হাজার হাজার
নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। নারিকেল গাছের বর্ণাঢ্যতায় মনে হয় এক হিন্দোলিত
সবুজ বাগান। আজকে চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত সেন্টমার্টিনকে দেখে অবাক
বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলাম। কোটি কোটি বর্গমাইল সাগরের ভেতর মাত্র কয়েক
বর্গমাইলের একটি দ্বীপ, মনে হয় একটি সুন্দর মুখাবয়বে একটি চমৎকার তিলক।
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। হাজার হাজার লাখ লাখ কোরাল
বা রীফের মৃত ফসিলের কেলাস বা সম্মিলনে সাগরের বুক চিরে মাথা তুলেছে এই
সুন্দর দ্বীপ। দ্বীপের সৈকত ধরে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। সৈকত জুড়ে
এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রবাল। কোথাও স্তুপ হয়ে পড়ে আছে
বিশাল প্রবাল।
[প্রবালের উপর লেখক ও সঙ্গীরা]
আমি, নিশিথ, জুবায়ের ও হাফিজ এক সাথে
প্রবালে বসে ছবি তুলি। সেন্টমার্টিনের মূল আকর্ষণই হলো এ প্রবাল। এর মধ্যে
কয়েকজন পিচ্ছি এসে আমাদেরকে ঘিরে ধরল। কারো হাতে ছোট ছোট প্রবাল বিক্রির
জন্য নিয়ে আসছে। আবার কেউ টাকার বিনিময়ে আমাদেরকে পুরো সেন্টমার্টিন এলাকা
ঘুরিয়ে দেখাতে চায়। আমরা সালাম নামক এক কিশোরকে পেয়ে গেলাম। তাকে নিয়ে আমরা
বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের টিনশেট বাংলোয় গেলাম। সাগর পাড়ে
মনোরম পরিবেশে এই বাংলোটি তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের থাকা ও বিশ্রাম নেয়ার
জন্য। পর্যটকরা যখন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যায় তখন একটু বিশ্রাম নেয়ার
জন্য এখানে ছুটে আসে। অনেকে দুর্বা ঘাসের উপর বসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস
ছাড়ে। আমাদের দলটিও এখানে এসে বসল। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ডাব নিয়ে আসছে। ১০
টাকার বিনিময়ে অনেকে ডাব কিনে খেল। মোশারফ স্যারকে নিয়ে আমরা কয়েকজন
হুমায়ুন আহমেদের বাংলোর বারান্দায় ছবি তুললাম।
[হুমায়ুন আহমেদের বাংলোর বারান্দায় লেখক ও সঙ্গীরা।]
এক গবেষণায় দেখা গেছে এ দ্বীপে ৬৮ প্রজাতির
প্রবাল আছে। তবে আমরা এখানে শুধু মাত্র মৃত প্রবালগুলো দেখতে পায়। জীবিত
প্রবালগুলো থাকে সমুদ্রের নীচে। তাই আমরা তা দেখতে পাই না। সেন্টমার্টিন
এর আরেকটি অংশ হল ছেড়া দ্বীপ সেখানে স্বচ্ছ পানির নিচে রঙ্গিন মাছ দেখতে
পাওয়া যায়। সময় স্বল্পতার জন্য আমাদেরকে ছেড়া দ্বীপে নিয়ে যায়নি। এইজন্য
প্রথমে মন খারাপ লেগেছিল। পরে সেন্টমার্টিনের সুন্দর্য উপভোগ করে তা ভুলে
গেলাম। ছেড়া দ্বীপটি হল বাংলাদেশর সর্ব দক্ষিণে এবং সর্বশেষ সীমানা। যা হোক
প্রবালের পর সেন্টমার্টিনের আরেকটি সম্পদ হলো সামুদ্রিক মাছ। এখানে ১০০শত
প্রজাতির মাছের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। আর মাছের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় মাছ
হলো চান্দা মাছ। প্রায় ২০ রকমের চান্দা মাছ আছে। এর মধ্যে প্রধান
রূপচান্দা। তারপর কালা চান্দা, খয়েরি চান্দা, টেক চান্দা, সুন্দরী চান্দাসহ
আরো কত নাম। মাছের মধ্যে আরো আছে আচিলা, গুইজা, দাতিনা, গোমটা, পোয়া, চিছা
তারা, কোরাল, বাটা, ছুরি, পটকা, ফ্লাইংফিস, মাইট্যা সুন্দরী, বাইন, পিসকি,
ভোল, হটা, মোতারা, লাল মাছ, পাতা মাছ ইত্যাদি অসংখ্য মাছ। আরো আছে শুশুক,
হাঙ্গর, ডলফিন, শাপলা পাতা মাছ, তারা মাছ, জেলি মাছ, শামুক, ঝিনুক, কড়ি,
কাকড়া, কিংক্র্যাব, কচ্ছপ সাগর শসা বা সি কুকুমবার।
[কেয়া গাছের শিকড়ে বসা লেখক ও বন্ধুরা]
এখানে আছে ২০ রকমের শৈবাল। এর মধ্যে
গ্রিসিলারিয়া, উলরা টারবিনাসিয়া, পাদিনা, সারসাসাম। উদ্ভিদের মধ্যে নারিকেল
গাছের পরেই নজর কাড়ে কেয়া গাছ। শক্ত বৈসমূলে হেলান দিয়ে আনারসের পাতার মতো
পাতা নিয়ে অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে এগুলো। গোলাকার আনারসের মত কেয়া ফুল ঝুলছে
গাছে। অনেকে কেয়া ফুল পেড়ে নিল। আমরা কয়েকজনে মিলে কেয়া গাছের গুড়িতে বসে
ছবি তুললাম। ধু-ধু বালির মধ্যে আর একটি লতা গাছ দেখতে পেলাম। এর নাম সাগর
কলমি। মাইকের মত এর ফুলগুলো। তপ্ত বালুময় মরুর বুকে সবুজ কোমল লতা আচ্ছাদিত
করে রেখেছে বালিকে। অর্পূব দৃশ্য! এসব দৃশ্যক্যামেরায় বন্দি করতে একটও
কার্পণ্যবোধ করিনি। তাছাড়াছিটকি গাছ, হরগোজা, কলা, নিশিন্দা,ফণীমনসা,
অরবরই,আম গাছসহ অনেক গাছ চোখে পড়ে। টমেটো,বেগুন ও ধান এখানে চাষ করা হয়। এ
দ্বীপের প্রায় সব বাসিন্দাই জেলে। সাগর থেকে মাছ ধরাই এদের পেশা। তাই দ্বীপ
হতে প্রতিদিন অহরহ মাছ শিকার করা হচ্ছে। এই মাছ তারা শুটকি হিসেবে ব্যবহার
করে।
আমরা ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আবার বাজারে
ফিরে এলাম । এখান থেকে আমি ও জুবায়ের রুপচান্দার শুটকি ক্রয় করি। পরে ২টার
সময় ‘হাজী সালাম পার্ক এন্ড রেস্টুরেন্টে’এ দুপুরের খাবার খেলাম। খাওয়ার পর
কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। পৌনে তিনটায় আবার জাহাজে উঠলাম। মাত্রআড়াই
ঘন্টায়সেন্টমার্টিন সফর। এত অল্প সময়ে সবকিছু দেখা সম্ভব হয়নি। যেতে ইচ্ছে
করছে নাতবুও যেতে হচ্ছে। তিনটার সময় জাহাজ টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।
জাহাজে থেকেই সূর্যাস্তের দৃশ্যটি উপভোগ করলাম। ক্যামেরা বন্দি করলাম
পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সূর্যটিকে। ৫:৩০ মিনিটে আমরা টেকনাফ এসে পৌছলাম।
সেখান থেকে ৬টায় টেকনাফ বার্মিজ মার্কেটে আসলাম। সাড়ে সাতটায় কক্রবাজারের
উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।১০টায় হোটেল লেমিছ এ ফিরে আসি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন