এক.
১৯৯৫ সাল।
শীতের সকাল। চারদিকে কুয়াশা। কুয়াশার জন্য দূরের লোকজন তেমন দেখা যায় না। এখনও সূর্য উঠেনি। জসিম উদ্দিন রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন। ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি হাঁটেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার কাছে মনে হল কোথাও একজন কাঁদছে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দেখলো আট-নয় বছরের একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জসিম উদ্দিন যতই সামনে যাচ্ছে ততই মেয়েটি সামনে আসছে। মেয়েটি ইতোমধ্যে জসিম উদ্দিনের কাছাকাছি চলে আসলো। জসিম উদ্দিন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি তাকে ঝাপটে ধরে বললো, আংকেল আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে। আব্বুকে খুঁজে দেন। বলেই সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মেয়েটি হঠাৎ জসিম উদ্দিনকে ঝাপটে ধরায় তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু এই সকাল বেলায় এখানেই বা এলো কি করে? তার বাবাকেই বা তিনি কিভাবে খুঁজে দেবেন। জসিম উদ্দিন মেয়েটিকে দুই হাতে সারিয়ে বললো, এই মেয়ে এসব কি বলছ?
জসিম উদ্দিনের প্রশ্নে সে আরো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
- এই মেয়ে কাঁদছ কেন? বল কি হয়েছে?
মেয়েটি শীতে থর থর করে কাঁপছে আর কাঁদছে। মনে হয় জসিম উদ্দিনকে পেয়ে তার কিছুটা সাহস হয়েছে। তাই আবার বললো, আমার আব্বুকে খুজে দেন আংকেল।
- কি হয়েছে তোমার আব্বুর?
- আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে?
- এতটুকুন মেয়েকে রেখে কোন বাবা চলে যেতে পারে? ঘটনা কি সত্যি করে বল। তুমি তোমার বাবার সাথে রাগ করেছো?
- না আমি রাগ করিনি।
- তোমার নাম কি?
- সাদিয়া।
- কোথায় তোমার বাড়ি?
- ঢাকা আমাদের বাড়ি।
-এখানে আসলে কি করে?
- চট্টগ্রাম থেকে আব্বুর সাথে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে সামনের স্টেশনে ট্রেন থামে। আব্বু তখন ট্রেনে বসে ঘুমাচ্ছিল। তখন আমি ট্রেন থেকে নামি। নামার কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আমাকে রেখে চলে গেল। আমি আর ট্রেনে উঠতে পারিনি।
- কেন নামছিলে?
- দেখার জন্য।
- বাবাকে কেন সজাগ করলে না?
- আমি কি জানি ট্রেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
- এখন কি করবে কিভাবে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করব? ঢাকার কোন জায়গায় তোমাদের বাসা?
- বনানী।
- বাসা নম্বর কত জান?
- না।
- তাহলে তোমার বাবাকে কোনদিনই আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।
- তুমি এক কাজ কর। আমার কোন সন্তান নেই। তুমি আমার বাসায় থাকতে পার। আমাকে তুমি বাবা ডাকবে। আমি মেয়ের মতো তোমাকে লালন পালন করব।
- না আপনাকে আমি বাবা ডাকব না। আপনি আমার বাবাকে বের করে দিন।
- ঠিক আছে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার বাবাকে খুঁজে বের করার জন্য। যদি না পাই তাহলে আমার বাসায় থাকবে।
- ঠিক আছে।
সাদিয়া জসিম উদ্দিনের বাসায় থাকতে রাজি হওয়ায় তাকে নিয়ে তিনি বাসায় আসলেন।
জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিয়ে ঢাকার বনানীর অলিগলি সব জায়গায় ঘুরলো। সাদিয়া তাদের বাসা জসিম উদ্দিনকে চিনাতে পারেনি। তাই তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার আব্বুকে খুঁজে বের করতে পরেননি। সেই থেকে জসিম উদ্দিনের বাসায় সাদিয়া তার মেয়ে হয়ে থাকতে শুরু করলো।
জুলফিকার আলীর একমাত্র মেয়ে সাদিয়া ছিল নয়নের মনি। তাকে হারিয়ে তিনি এখন পাগল। হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে মেয়েকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মেয়ের খোঁজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেল লাইনের প্রতিটি স্টেশনে তিনি খুঁজেছেন। কোথাও মেয়েকে পাননি। মেয়ের শোকে তিনি পাগল হয়ে গেলেন। রাস্তায় যখন যাকে দেখেন তখনই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মেয়েকে খুঁজে দাও। তিনি আর বাসায় ফিরে যাননি। সেই থেকে তার ঠিকানা হলো রেলস্টেশন।
দুই
২০১৫ সাল।
জসিম উদ্দিন এখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। আর সাদিয়ার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর। জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিজের মেয়ে মনে করে তার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তাকে পড়াশুনা করিয়েছেন। সাদিয়া এখন দেশের একজন নামকরা ডাক্তার। সাদিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছেন জসিম উদ্দিন। শেষ বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে নাতির মুখ দেখে মরতে চান তিনি।
সাদিয়া আজ বড় ডাক্তার। দেশের অসহায় মানুষের চিকিৎসা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজেই তার পোস্টিং। প্রতিদিন শত শত অসহায় রোগীর চিকিৎসা করেন। বৃদ্ধ কোন রোগী দেখলেই তার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।
আজ হঠাৎ করে ৬০/৬১ বৎসরে একটি পাগল তার চেম্বারে এসে হাজির। উসকু খুসকু চেহারা। দাড়ি গোফে সারা মুখ একাকার। মাথায় চুলের ঝটলা। পাগল লোকটি ডা: সাদিয়াকে বললো, এই ডাক্তার আমার মেয়েকে খুঁজে দাও।
পাগলের কথা শুনে ডা: সাদিয়া চমকে উঠলো, আপনি এসব কি বলছেন? আমি আপনার মেয়েকে কোথায় পাব?
- পাবে! রেল স্টেশনে পাবে! ট্রেনের ভেতর পাবে!
- কি বলছেন আপনি? আপনার মেয়ের নাম কি?
- সাদিয়া।
- সাদিয়া!
পাগলের মুখে এ কথা শুনতেই সাদিয়া চমকে উঠলো। কি বলছে ওনি। রেল স্টেশন! সাদিয়া! ট্রেন! তার স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়লো ছোটবেলায় রেল স্টেশন থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু ওনি কে? কে আপনি?
আমি জুলফিকার পাগল।
হ্যাঁ মনে পড়ছে সাদিয়ার। তার বাবার নাম জুলফিকার। তাহলে ওনিই আমার পিতা!
চেহারার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল তার বাম গালে বড় একটি তিল আছে। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে তার আব্বুর গালেও তিল ছিল। এ আর কেউ নয়। তিনি আমার আব্বু। আমার খুঁজে দীর্ঘ বিশ বছর পাগল অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর ভাবতে পারছে না। আব্বু বলেই চিৎকার দিয়ে জুলফিকার পাগলকে জড়িয়ে ধরলো।
জুলফিকার পাগল বললো, না তুমি আমার মেয়ে না। আমার মেয়ে ডাক্তার না।
- না আব্বু আমিই তোমার সেই হারানো মেয়ে। দেখ আজ আমি কত বড় হয়েছি। দেশের নামকরা ডাক্তার হয়েছি। আমি আর সেই ছোট্ট খুকিটি নেই।
- সত্যি বলছিস? তুই আমার বুকের ধন। তুই আমার কলিজার টুকরা সাদিয়া। আয় আমার বুকে আয় মা। তোকে পেয়ে আজ আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।
- আব্বু তোমার এই অবস্থা কেন?
- শুধু তোর জন্য। তুকে না পেয়ে দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত রেল স্টেশনে থেকেছি। শুধু তুর দেখা পাব বলে। এই বলেই পকেট থেকে সেই ছোট্ট সাদিয়ার একটি সাদাকালো ছবি বের করে বললো, এই দেখ সেই ছোট্ট বেলায় তুকে হারিয়েছি। আজও তোর ছবি বুকে নিয়ে ঘুরছি।
এই ছবি দেখে ডাঃ সাদিয়া অজোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
- এই কাঁদবি না। আজ আর কাদার দিন নয়। চল বাড়ি চলি।
- না বাবা। যার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি। যার আশ্রয়ে আমি আজ ডাঃ হয়েছি তাকে না বলে কিভাবে বাড়ি যাই? যার মায়া মমতায় তোমার কথা আমাকে ভুলিয়ে রাখছে তাকে তুমি দেখে যাবে না?
সাদিয়া তার বাবাকে সেলুন থেকে গোফ দাড়ি কাটালো। নতুন পাঞ্জাবী পড়িয়ে তার বাসায় নিয়ে আসলো। এসেই তার পালিত বাবা জসিম উদ্দিনের রুমে ঢুকলেন।
জসিম উদ্দিন জুলফিকার কে দেখে বললো, সাদিয়া মা ওনি কে?
- বাবা এ হচ্ছে আমার জন্মদাতা আব্বু। এই আব্বুর খোঁজে দীর্ঘ ২০ বছর যাবত আমি তোমার বাসায় আশ্রিত হয়ে আছি।
- এসব কি বলছিস মা! তুই আশ্রিত হবি কেন? তুইতো আমার মেয়ে। বুকের ধন। আমি তুকে জন্ম দেয়নি ঠিক কিন্তু তুকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো করেই লালন পালন করেছি। তুকে পেয়ে আমি পিতার স্বাদ পেয়েছি। তুকে না পেলে হয়তো এতদিন বেঁচে থাকতাম না।
- এই জন্য বাবা আমি তোমার কাছে চির ঋণী। কিন্তু আজ বাবা আমাকে বিদায় দিতে হবে। আমি আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে চাই।
এ কথা শুনার পর জসিম উদ্দিন বললো, একি বলছিস মা। এ আমি পারব না। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।
- কিন্তু বাবা কিছু করার নেই। আমাকে আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে।
- না তুই যেতে পারবি না। যেতে হলে আমার বুকের উপর দিয়ে যেতে হবে। এই বলেই জসিম উদ্দিন ডা: সাদিয়ার সামনে শুয়ে পড়লেন।
ডা: সাদিয়া এ দৃশ্য দেখে নির্বাক হয়ে গেলো।
রচনাকাল: ১৫/১১/২০১৫ইং
২টি মন্তব্য:
গল্পটি বেশ সুন্দর লিখেছো।
তোমার সাইটটি এখন চমৎকার হয়েছে।
শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ কাবুল ভাই গল্পটি পড়ার জন্য। আর সাইটটি আপনার পরামর্শ মোতাবেক সাজানোর চেষ্টা করছি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন