ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মা আমাদেরকে দোয়া করে বলেন, ‘বাবা ভালোভাবে ফিরে এসো।’ কিন্তু বর্তমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে কয়জন মায়ের সন্তান স্বাভাবিক ভাবে ফিরে আসতে পারে? বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতে চোখ রাখলে প্রতিদিন যেসব খরব শুনি তাহলো কোন না কোন দুর্ঘটনায় বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় মৃত্যু।
আজ আমরা কোন মায়ের সন্তানই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারি না। আমরা সবাই যে জিনিসটিকে এক বাক্যে সত্য বলে মেনে নেয় তা হলো মৃত্যু। মৃত্যুর চেয়ে কঠিন সত্য পৃথিবীতে আর নেই। প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন মৃত্যু বরণ করতে হবে। একথা ধ্রুব সত্য। তাই বলে কি অস্বাভাবিক ভাবে যখন তখন কোন দুর্ঘটনায় বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হবে?
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। অকালে ঝড়ে পড়ছে অনেক মানুষের জীবন। আবার কেউ বা পঙ্গুত্ববরণ করে অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এই সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মতো মানুষদেরকেও হারাতে হচ্ছে। হারাতে হচ্ছে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনির ও তারেক মাসুদকে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ৪০ জন স্কুল ছাত্রের নিহতের কথাতো আমরা কেউ ভুলতে পারিনা। বর্ষা মৌসুম আসলেই লঞ্চ, নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটছে। অসংখ্য প্রাণ নিমিষেই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন দুর্ঘটনা হচ্ছে। এতেও দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষের প্রাণহানী হচ্ছে। কয়েক বছর আগে নরসিংদীতে ঘটে গেল বিরাট ট্রেন দুর্ঘটনা। কিছুদিন পর পর দেশের গামেন্টসসহ অসংখ্য দোকানপাটে আগুন লাগছে। কিছুদিন আগে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড গামেন্টেস এ আগুন লেগে শত শত প্রাণ পুড়ে ছাই হলো। ২০১০ সালে হামিম গামেন্টসসহ তিনটি গামেন্টেস এ অনেক মানুষের প্রাণ চলে যায়।
তাছাড়া রাজৈনিক হামলার শিকার হয়ে গত বছর ৯ ডিসেম্বর বিরোধদলের অবরোধ চলাকালে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয় টেইলার্স কর্মী বিশ্বজিত। এইভাবেই বিরোধীদলের প্রতিটা কর্মসূচীতেই সরকারের রোষানলে পড়ছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। আরেকটি অস্বাভাবিক ঘটনা ইদানিং এদেশে ঘটছে তা হলো গুম। ইলিয়াছ আলীর মতো বড় মাপের নেতা গুম হয়ে যায়। এদেশের সরকার ও আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী এর কোন হদিস পায়না। গত কয়েকদিন আগে ৭/৮ জন লোক র্যাব পরিচয় দিয়ে বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদারকে ধরে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের হাতকড়া অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। প্রতি বছরই বোমা হামলায় শিকার হয়ে এ দেশে অসংখ্য প্রাণ দিতে হয়েছে। গত আওয়ামীলীগ সরকারের আমল থেকে আজ অবধি বোমা হামলা হয়েই যাচ্ছে। স্মরণ কালের ভয়াবহ বোমা হামলাটি হয়েছিল ২০০৪ সনে আওয়ামীলীগের সমাবেশে। এখানে অসংখ্য মানুষের প্রাণ চলে যায়। কিছুদিন যাবত যে ঘটনাটি ভারতসহ আমাদের দেশে খুবই আলোচিত হচ্ছে তা হলো ধর্ষণ। ধর্ষণ করে ধর্ষীতাকে হত্যা করছে কিছু মানুষ রূপী নরপশু।
সম্প্রতি সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (এমআরটি'র)- এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছে ৭৯০ জন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে ৪৫৯ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৫৮৮ জন। উক্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর খুন হয়েছে ৪,৪১২ জন। সময়ের হিসাবে দেখা গেছে শুধু মাত্র ২০১২ সালে প্রতিদিন গড়ে ১২ জন মানুষকে খুন করা হয়েছে। আর প্রতি দুই ঘন্টায় খুন হয়েছে ১ জন।
প্রতিদিন যেভাবে অস্বাভাবিকভাবে মানুষ মরছে তাতে করে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। আসুন আমরা এ থেকে পরিত্রানে উপায় বের করি। সবাই এক সাথে বলি, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। এই সব দুর্ঘটনা ও রাজনৈতিক বলির হাত থেকে আমাদের দেশ কি রেহায় পাবে না? এর কি কোন প্রতিকার নেই? অবশ্যই আছে। মুচি থেকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রতি পর্যন্ত সবাই যদি সচেতন হই তাহলেই অবশ্যই কিছুটা হলেও আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাব।
চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াছ কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করছে। তাঁর স্ত্রীও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা কি পারি না তাঁর সেই আন্দোলনে শরীক হতে?
সড়ক দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ
সরকারকে যেসব পদেক্ষপগুলো নিতে হবেঃ পুরনো ট্রাফিক আইন বাতিল করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। দুর্ঘটনার কারণ যাচাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দুই লাইনে রাস্তা তৈরি করতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। রাস্তা ঘাটের উন্নতি করতে হবে। জরাজীর্ণ ও ঝুকিপূর্ণ ওভার ব্রিজ গুলো সংস্কার করতে হবে। ফুটপাত থেকে অবৈধভাবে বসা হকারদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং তাদের পূর্ণবাসন করতে হবে। পথে পথে বাজার তৈরি করা বন্ধ করতে হবে। রাস্তায় যান চলাচলের বাধা সৃষ্টি করে সভা, মিটিং মিছিল বন্ধ করতে হবে। চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবহনের গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। সিট বেল লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আমরা যা করবঃ সবোর্চ্চ সর্তকতা অবলম্বন করে রাস্তা পার হবো। কখনো দৌঁড়ে রাস্তা পার হবো না। ওভার ব্রিজ অথবা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হবো। রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাঁটবো। বাসে ঘুমাবো না। দ্রুত গাড়ি চালানোর জন্য চালককে চাপ দিব না। চালকের সাথে কথা বলব না। জানালার পাশে বসার সময় লক্ষ্য রাখব শরীরের কোন অঙ্গ প্রতঙ্গ যেন জানালার বাইরে না যায়। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যান বাহনে উঠব না। তাড়াহুড়া করে চলন্ত বাসে উঠার জন্য দৌঁড়ে উঠব না। মুঠো ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হবো না। রাস্তায় কোন কিছু শুকাতে দিব না।
গাড়ীর মালিকরা যা করবেন নাঃ মেয়াদ উর্ত্তীণ গাড়ী রাস্তায় নামাবেন না। নির্দিষ্ট বেতন ছাড়া ড্রাইভার নিয়োগ দিবেন না। অদক্ষ ও লাইসেন্স বিহীন ড্রাইভার নিয়োগ দিবেন না। হেলপার দিয়ে গাড়ি চালাবেন না। কিশোরদেরকে দিয়ে গাড়ি চালাবেন না।
চালকরা যা করবেন নাঃ নেশা যাতীয় কিছু খেয়ে গাড়ি চালাবেন না। চলন্ত অবস্থায় মুঠো ফোনে কথা বলবেন না। দ্রুত ওভারটেক করার চেষ্টা করবেন না। হাইওয়েতে কোন অবস্থায় ঘন্টায় ৮০ কিমি এর বেশি বেগে গাড়ি চালাবেন না। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে গাড়ি ছাড়বেন না। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র গাড়ি দাড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করবেন না। যেখানে সেখানে ওভারটেকিং করবেন না। অযথা হাইওয়েতে গাড়ি দাড় করিয়ে রাখবে না।
চালকদেরকে যা করতে হবেঃ ট্রাফিক আইন মেনে চলবেন। সিট বেল লাগাবেন। মোড়ে এসে অবশ্যই হুইসেল বাজাবেন। রাতে দুরপাল্লার বাস বা ট্রাক ছাড়ার আগে হেড লাইট গুলো চেক করে নিবেন।
লঞ্চ ও নৌ দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রানের উপায়ঃ
সরকারকে যেসব পদপেগুলো নিতে হবেঃ এ ব্যপারে সরকারকে আইন করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা যা করবঃ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চে ও নৌকায় উঠার আগে একবার ভাবব, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী।
সারেং ও মাঝিরা যা করবেন নাঃ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চ ও নৌকা ছাড়বেন না। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝায় করে লঞ্চ ও নৌকা না ছাড়বেন না।
ট্রেন দুঘর্টনা থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ
সরকারকে যেসব পদেক্ষপগুলো নিতে হবেঃ রেলওয়ের প্রতিটি ক্রসিংগুলোতে গেট ব্যারিয়ার ও গেটম্যানের ব্যবস্থা করা।
আমাদের যা করতে হবেঃ দ্রুত ট্রেনের উঠার চেষ্টা করব না এবং ট্রেন থেকে নামার সময় দ্রুত নামব না। ট্রেনের ছাদে উঠব না। ইঞ্জিন বা ট্রেনের বগির পেছনে উঠব না।
আগুন থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ
সরকারকে যেসব পদেক্ষপগুলো নিতে হবেঃ শ্রম আইনের বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটা ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে ফায়ার সার্ভিস চালু করতে হবে।
আমরা যা করব নাঃ অকারণে একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখব না। একান্ত বাধ্য না হলে গ্যাসের চুলায় জামা কাপড় শুকাবো না। ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে আগুন নিয়ে খেলা করতে দিব না। মশারীর নিকট মোম বাতি বা কুপি রাখবো না।
আমরা যা করবঃ যদি অতিরিক্ত শীত এবং রোদ না থাকলে বাধ্য হয়ে জামা কাপড় শুকাতে হয় তাহলে সর্তকতার সহিত শুকাবো। রাতে কয়েল ধরানোর সময় সর্তকতার সহিত ধরাবো এবং জিনিস পত্র থেকে একটু দুরে রাখব। বিদ্যুতের লাইন, সুইচ বোর্ড মাঝে মাঝে চেক করবো। আগুন লাগার সাথে সাথে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিব এবং নিজেরা যতটুকু সাধ্য আছে তা দিয়ে আগুন নেবানোর চেষ্টা করব।
গামেন্টস মালিকদেরকে যা করতে হবেঃ বিদ্যুতের লাইন মাঝে মাঝে চেক করার ব্যবস্থা করবেন। দুই লাইনের সিড়ির ব্যবস্থা রাখবেন যাতে আগুন লাগলে সবাই নিরাপদে বের হয়ে আসতে পারে। আগুন লাগার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিবেন। আগুন নেভানোর জন্য গামেন্টেসের কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আগুন লাগলে মাইকিং করে সকল
কর্মচারীদেরকে ফ্যাক্টরী থেকে বের হওয়ার জন্য বলবেন।
রাজনৈতিক হত্যার থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ
সরকারকে যেসব পদেক্ষপগুলো নিতে হবেঃ সবার আগে সরকারকে সহনশীল হতে হবে। বিরোধীদলের যৌক্তিক আন্দোলনে কোন বাধা দেয়া যাবে না। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
বিরোধীদল যা করবে নাঃ হরতালের নামে গাড়ী পোড়ানো যাবে না।
পরিশেষে বলবো উপরোক্ত পরিত্রাণের উপায়গুলো সরকারের উচ্চ
মহল থেকে শুরু করে আমি, আপনি সবাই যদি মেনে চলি এবং যার যার জায়গায় থেকে সচেতন হয় তাহলে
অবশ্যই কিছুটা হলেও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাবো।
রচনাকালঃ ১২ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রি:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন