সম্প্রতি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম দমনে পুলিশের মাধ্যমে সরকার বিদেশ থেকে আনা মরিচের ঝাঁঝযুক্ত ‘পিপার স্প্রে’ নামক নতুন অস্ত্র ব্যবহার করছে। রাজপথে পিপার স্প্রে ব্যবহার নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। পিপার স্প্রে নিয়ে যেমন জনগণের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তেমনি শুরু হয়েছে নানা সমালোচনাও। এই স্প্রে নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত সারাদেশে আলোচনার ঝড় বইছে। কেমিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনের ১.৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুদ্ধে প্রতিপক্ষ দমনে পিপার স্প্রে ব্যবহার
হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের পিপার স্প্রে ব্যবহারের খবর। ৯
জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলনরত নন-এমপিও শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করতে ঢাকায়
প্রথম পিপার স্প্রে ব্যবহার করে পুলিশ। গত ১৬ জানুয়ারি বুধবার জ্বালানী তেলের বৃদ্ধির
প্রতিবাদে বাম দলগুলোর হরতালেও পিকেটারদের ওপর ঐ স্প্রে ব্যবহার করা হয়। এতে আহত হয়েছেন
বেশ কয়েকজন। নতুন ধরনের এই স্প্রে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন জাগায়। অভিযোগ উঠেছে
শিক্ষকদের ওপর পুলিশের পিপার স্প্রের কারণে এক শিক্ষক মারা গেছেন। আন্দোলনরত ভোক্তভুগী
শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই জানান, মরিচের গুঁড়া শরীরে ছিটানো হলে ঝাঁজালো যে ধরনের অনভূতি হয়, পিপার স্প্রের কার্যকারিতাও একই ধরনের। পিপার স্প্রেতে
যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চোখে অসহনীয় জ্বালা পোড়া করছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে।
এমনকি ত্বকেও তীব্র জ্বালাযন্ত্রণা হচ্ছে।
সমালোচক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর পিপার স্প্রে বিশ্বের বহু দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই
স্প্রে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি সাধারণত ভয়ংকর জীবজন্তুর আক্রমন ঠেকাতে
ব্যবহার করা হয়। এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে লিভার ও চোখের ক্ষতি হতে পারে। এমনকি
মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন,
এই গ্যাসে চোখের কর্নিয়া টিস্যুগুলো
নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গ্যাসে আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ মেয়াদে চোখে ঝাপসা দেখতে পারেন।
মানবদেহের অন্য অংশের কোনো টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ওষুধ প্রয়োগে ঠিক হওয়ার সম্ভবনা
থাকে। কিন্তু চোখের কর্নিয়া নষ্ট হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঠিক হয় না। এ ছাড়া, পিপার গ্যাসে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে।
উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, পিপার গ্যাসে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর
এই গ্যাস মৃত্যুরও কারণ। দ্য লস এঞ্জেলস টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় ১৯৯৫ সালে আমেরিকায়
জনতার ওপর পুলিশ পিপার স্প্রে প্রয়োগ করায় কমপক্ষে ৬১ জনের মৃত্যু ঘটে। দ্য আমেরিকান
সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)-এর এক তথ্যপ্রমাণে বলা হয় ১৯৯৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায়
পুলিশ হেফাজতে পিপার স্প্রেতে আক্রান্ত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যু ঘটে।
অথচ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, রোগ না থাকলে পিপার স্প্রের কারণে কারো মৃত্যুর কোন আশংকা নেই। যদি না, কারো কোনো পূর্ব দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে থাকে। তিনি
বলেন, এই গ্যাস অতীতেও অনেকবার ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা
এটাকে আরো সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। রাবার বুলেটের ব্যবহার কমাতে এর প্রয়োগ
করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
পিপার স্প্রে ব্যবহার করছে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখা হচ্ছে।
তবে পিপার স্প্রেতে প্রাণহানি ঘটার কোনো কারণ নেই।
অন্য দিকে পুলিশ বলছে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বিক্ষুদ্ধ জনতাকে দমনের জন্য কাঁদানে গ্যাস যেমন
ব্যবহার করা হয় তেমনি পিপার স্প্রে কাঁদানে গ্যাসের আধুনিক রূপ। এটি কাঁদানে গ্যাসের
নতুন সংস্করণ। এটিতে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। টিয়ারশেল আর পিপার স্প্রের কার্যকারিতা
প্রায় একই ধরনের। আগে রাজপথে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ব্যবহার করত। অনেক সময় টিয়ারশেল
সঠিক টার্গেটে ছোড়া সম্ভব হতো না। এমনকি কোনো টিয়ারশেল বিস্ফোরিত না হলে বিক্ষোভকারীরা
উল্টা পুলিশের ওপর ঢিল ছুড়ত। অন্যদিকে পিপার স্প্রে খুব কাছ থেকে টার্গেটের ওপর ব্যবহার
করা যায়।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান
বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত এমন বিষাক্ত
রাসায়নিক গ্যাস কীভাবে পুলিশ রাজপথে মানুষের ওপর ব্যবহার করে? তিনি বলেন, কুকুর ও ভাল্লুক থেকে রক্ষা পেতে পৃথিবীর অনেকে দেশে পিপার স্প্রে অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহৃত হয়। পিপার স্প্রে ব্যবহার বন্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান
তিনি।
মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর দাবি করে পিপার স্প্রে ব্যবহার বন্ধের
জন্য সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোটের আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। পিপার
স্প্রে ব্যবহার বন্ধ না হলে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে নোটিশে বলা হয়েছে।
সরকার এবং পুলিশের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় এটি এক ধরনের
শান্তিদায়ক স্প্রে। আর আক্রান্ত ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় এটি একটি মারাত্মক
ক্ষতিকর স্প্রে। পুলিশের অস্ত্র ভান্ডারে সম্প্রতি যোগ হওয়া এই নতুন স্প্রে নিয়ে ইতিমধ্যেই
দেশজুড়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা চাই এর শান্তিপূর্ণ সমাধান। আন্দোলন-সংগ্রাম
দমনের নামে সরকার যাতে এমন কিছু ব্যবহার না করে যাতে মানুষের প্রাণহানী ঘটে। এতে করে
সরকারই বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে।
রচনাকালঃ ১৯ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রি:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন