বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের মূল গেইট, ছবিটি তুলেছি অামি নিজেই
|
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এখন সাফারি পার্ক আছে।
চট্টগ্রামে ‘ডুলাহাজারা সাফারী পার্ক’ নামে একটি সাফারী পার্ক আছে। সেটি চট্টগ্রাম শহর হতে ১০৭ কিলোমিটার
দক্ষিণে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপার্শ্বে চকোরিয়া উপজেলা হতে মাত্র ৫
কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। একা যাওয়া সম্ভব নয় বিধায় নরসিংদী সরকারি কলেজের
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯ নভেম্বর ২০০৫ সালে আমি এই সাফারী পার্ক পরির্দশনে
গিয়েছিলাম। সেখানে বেড়াতে যাওয়া চট্টগ্রাম ব্যতিত সকলের জন্য অনেক কষ্টের ব্যাপার।
ঢাকার অদূরে গাজীপুরে এশিয়ার সর্ববৃহত্তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কটি অনেক
বড় এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় সকলের
জন্যে ভ্রমণ করা সহজ হয়েছে।
অনেকদিন যাবত ভাবছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে যাব। কিন্তু
এখানেও একা যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। এবার প্রিয় বন্ধু আব্দুল্লাহ আল নোমানের
আমন্ত্রণে আর দেরি করিনি। তাঁর কর্মস্থল মনোহরদী থানার ‘হাফিজপুর
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’র ৫০ জন
ছাত্র-ছাত্রী ও ৭ জন শিক্ষক নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে শিক্ষাসফরের
আয়োজন করেন। আমাকে স্বপরিবারে সে আমন্ত্রণ জানায়। আমি তার আমন্ত্রণে রাজি হয়ে যাই।
ভ্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ৭ মার্চ ২০১৬ খ্রি:।
সাফারি পার্ক নিয়ে আমার আলাদা একটা আগ্রহ আছে। বনের ভেতরে যেয়ে তো
আর বাঘ সিংহকে খোলামেলা দেখতে পারিনা, তাই দুধের স্বাদ
ঘোলে মেটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সাফারি
পার্ক সম্পর্কে এতোদিন শুধু শুনেছিলাম। কখনো সময় হয়নাই অথবা সঙ্গি হয়নাই তাই যেতে
পারি নাই। এবার সময় পেলাম স্বপরিবারে যাওয়ার। তাই আর এ সুযোগ হাতছাড়া করিনি।
৭ মার্চ ২০১৬ খ্রি: সকাল ৯:০০ টার সময় বনভোজনের বহনকারী বাসটি
মনোহরদী থেকে আমাদেরকে নিয়ে যাবে। তাই আমরা সকাল ৭:৩০ মিনিটেই বাসা থেকে বের হয়ে
গেলাম। ৯:০০ টার সময় মনোহরদী এসে উপস্থিত হলাম। নোমানকে ফোন দিতেই সে চলে আসলো।
নির্দিষ্ট স্থানে বনভোজনের বাসের জন্য অপেক্ষা করলাম। প্রায় ১০:০০ টার সময় বাস
আসলো। আমরা নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। আনন্দ হৈ হুল্লোরের মধ্যে কখন যে আমাদের
বহনকারী বাসটি বাঘের বাজার চলে আসলো তা বুঝতেই পারিনি। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৪০
কিলোমিটার উত্তরে গাজীপুরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত এই বাঘের বাজার।
নাম শুনে অনেকেই আনন্দিত হয়েছিল যে, এখানেই বোধহয়
বাঘের দেখা পেয়ে যাবে। কিন্তু না বাঘের দেখা পেতে আমাদেরকে আরেকটু কষ্ট করে সামনে
আগাতে হয়েছে। বাঘ দেখবো বলে কথা তাই যেতে হয়েছে আমাদেরকে আরো তিন কিলোমিটার
পশ্চিমে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চলে আসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী
পার্কের সীমানায়। অনেকটা দূর থেকেই চোখে পড়লো সাফারী পার্কের দৃষ্টিনন্দন ফটক।
আমরা বাস থেকে একে একে সবাই নেমে পড়লাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম সারি সারি ফুল গাছ।
বাঘ,
সিংহ, বাজপাখি, হাতি, জিরাফ, জেব্রা,
ক্যাঙ্গারু এমনকি বহু আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত ডাইনোসর আমাদেরকে
স্বাগত জানালো। তবে এগুলো প্রাণহীন, মাটি বালু ও সিমেন্ট
দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর ভাস্কর্য। আসল প্রাণী কিন্তু আমাদের জন্য ভেতরে
অপেক্ষা করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে পৌঁছলাম বেলা ১:০০ টার সময়।
ভ্রমণ লিডার স্যার সিদ্ধান্ত দিলেন দুপুরের খাবারের পর পার্কের ভেতর প্রবেশ করবে।
আমাদের জন্যে বরাদ্ধ পিকনিক স্পর্টে স্যার আমাদেরকে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে আমরা
ফ্রেশ হলাম। সবাই মাটিতে সারিবদ্ধভাবে বসে দুপুরের খাবার বিরানী খেলাম। যা আগে
থেকেই নরসিংদী থেকে পাক করে নিয়ে আসা হয়েছিলো। দুপুরের খাবারের পর আমাদেরকে টিকেট
কেটে সাফারী পার্কে প্রবেশ করালেন। এখানে প্রবেশ করেই আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কটির প্ল্যান অনেক সুন্দর। এখানে বাঘ, সিংহ, জেব্রা, হরিণ,
জিরাফ সব উন্মুক্ত ঘুরে বেরাচ্ছে আর আমরা খাচায় বন্দি হয়ে তা
দেখছি। ৪৯০৯.০ একর বনভূমি বিশাল জায়গা জুরে সাফারি পার্কটি করা হয়েছে। চিড়িয়াখানায়
মানুষ খাঁচার মধ্যে আর পশুপাখিরা মানুষকে দেখতে আসছে। ব্যাপারটা কেমন! এরকম না
হলেও অনেকটা কাছাকাছি অনুভূতির স্পর্শ পাচ্ছি এখানে এসে। সাফারি পার্ক হচ্ছে বন্য
প্রাণীর এক প্রকার অভয়ারণ্য। চিড়িয়াখানায় বণ্য প্রাণীরা থাকে বন্দি ও মানুষ থাকে
খোলা অবস্থায়। সাফারি পার্কে মানুষ থাকে বন্দি আর বন্যপাণীরা থাকবে খোলা অবস্থায়।
আমরা সারিবদ্ধভাবে গেইট পার হয়ে সাফারী পার্কের সরু পিচঢালা পথে
হাঁটছি। গভীর শালবনের ভেতর তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল ইটের সীমানা প্রাচীর। ভেতর দিয়ে
অসংখ্য সরু পিচঢালা এদিক ওদিক চলে গেছে। দুদিকে শাল, গজারিগাছসহ
নানা প্রজাতির গাছে আচ্ছাদিত। বিশাল এই অরণ্যে আমরা বের হয়েছি প্রকৃতির সান্নিধ্য
লাভের আশায়। ভেতরে আছে মানুষ খেকো ক্ষুধার্থ কয়েকটি হিংস্র বাঘ ও সিংহ।
দর্শনার্থীদের নিরাপদে চলার জন্য ও হিংস্র প্রাণীর আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
তৈরি করা হয়েছে কাঁচের দেয়াল। বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, কোর
সাফারি পার্ক, সাফারি কিংডম, বায়োডাইভারসিটি
পার্ক ও এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্কসহ মোট পাঁচটি অঞ্চলের সমন্বয়ে, তিন হাজার ৬৯০ একর ভূমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব সাফারী পার্ক।
কোর সাফারী পার্কের গেইট, ছবিটি তুলেছেন জনপ্রিয় ফটোব্লগার আমার প্রিয় বন্ধু কামাল উদ্দিন |
পার্কের প্রথমেই অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্কয়ার। পার্ক সর্ম্পকে যেকোনো
তথ্য জানার জন্য এখানে রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র। এখানে আরো
রয়েছে পার্ক অফিস। বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এর দর্শনীয় স্থাপনাসমূহের মধ্যে পার্ক অফিস, তথ্য কেন্দ্র, ডিসপ্লে ম্যাপ, গাইড ম্যাপ, বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরা, সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরা, ন্যাচারেল হিস্ট্রি
মিউজিয়াম, ঐরাবতী বিশ্রামাগার, প্রধান
ফটক, টিকেট কাউন্টার, ফোয়ারা,
বন্যপ্রাণী মডেল কর্ণার, ফুলের বাগান,
জলাধার, অফিসার্স ডরমেটরী, স্টাফ ডরমেটরী, পাবলিক টয়লেট, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, আরসিসি ছাতা, যাত্রী ছাউনী, সিটিং বেঞ্চ, পার্কিং এরিয়া, ওভার হেড ট্যাস্কসহ পানি
সরবরাহ, পাকা এপ্রোচ রোড, অভ্যন্তরীণ
পাকা রাস্তা, ইকো-রিসোর্ট উল্লেখযোগ্য।
হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে যেতেই হাতের ডান দিকে একটি রাস্তা দিয়ে
চলে গেছে যা দিয়ে কোর সাফারী পার্কে প্রবেশ করা যায়। কোর সাফারি পার্কটি এক হাজার ৩৩৫ একর এলাকায়
প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে বন্য পরিবেশে বন্য প্রাণীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে।
এখানে পার্কের গাড়িতে চড়ে বেষ্টনীর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, আফ্রিকান
চিতা, চিত্রা হরিণ, সাম্বার ও
গয়াল, হাতি, জলহস্থি, নীল গাই, বারো সিংগা, বন্য মোষ। কোর সাফারী পার্কে সাফারী গাড়ী ব্যতীত কোন পর্যটক প্রবেশ
করতে পারবেন না তবে তিনি বন্যপ্রাণী বেষ্টনীতে মুক্ত অবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবেশে
বিচরণরত বন্যপ্রাণী সমূহ গাড়ীতে চড়ে অবলোকন করতে পারবেন। কোর সাফারি পার্ক অঞ্চলে
আছে আফ্রিকান সাফারি পার্ক। এখানে রয়েছে আফ্রিকান বন্যপ্রাণীর বিশাল সংগ্রহ। বিশাল
দেহ আর লম্বা গলার জিরাফ দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানোর জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে।
এখানে আরো বিচরণ করে বন্যপ্রাণী জেব্রা। এই পার্কের দর্শনীয় স্থাপনাগুলো মধ্যে আছে
বাঘ সাফারী, সিংহ সাফারী, চিতা/সাদা
সিংহ সাফারী, ভল্লুক সাফারী, হরিণ
সাফারী, সাফারী জীপ ও মিনিবাস, আফ্রিকান
সাফারী, আভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা, বাঘের ঘর, সিংহের ঘর, মাংসাশী ও তৃণভোজী প্রাণী বেস্টনী, চিতার ঘর,
মেকানাইজড গেট, বার্ড আইল্যান্ড,
ভল্লুকের ঘর, যাত্রী ছাউনী, খাদ্য সংরক্ষণাগার, কোয়ারেন্টইন শেড, বন্যপ্রাণী চিকিৎসালয় ইত্যাদি।
সাফারি কিংডম গেইট, ছবিটি নেট থেকে সংগৃহিত |
আমাদের ভ্রমণ টিমে প্রাইমারী স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চা ছিলো। তাই
তাদেরকে নিয়ে ঐ বেষ্টনীর ভেতর প্রবেশ করেননি। এই জন্য আমারও গাড়ীতে চড়ে পার্কের
ভেতর হিংস্র প্রাণীগুলো দেখা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে আবার গেলে অবশ্যই এইদিকটা ঘুরে
আসব। আমরা চলে গেলাম বাম পাশে সাফারি কিংডম। ৫৭৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে
সাফারি কিংডম। এখানে আসতেই দুটো জিরাফ
আমাদেরকে স্বাগত জানালো। তবে সেটা জীবন্ত জিরাফ নয় ভাস্কর্য। আমরা সাফারি কিংডমে
প্রবেশ করলাম। সাফারী কিংডমে পর্যটকগণ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারে এবং
প্রাণিকূলকে ছোট-খাট বেস্টনীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। সাফারী কিংডমের মূল লক্ষ্য
হচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নৈপূণ্য ও খেলাধুলা প্রদশর্নের মাধ্যমে পর্যটকদের
চিত্তবিনোদন, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ
সৃষ্টি করা। সাফারী কিংডম এর দর্শনীয় স্থাপনাসমূহের মধ্যে পাহার গেট, প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র, প্যারট এভিয়ারী,
ক্রাউন ফিজেন্ট এভিয়ারী, ম্যাকাউ
ল্যান্ড, ধনেশ এভিয়ারী, ছোট
পাখিশালা, ফেন্সি কার্প গার্ডেন, ফেন্সি ডাক গার্ডেন, কুমির পার্ক, ইমু/অস্ট্রিচ গার্ডেন, লিজার্ড পার্ক, কচ্ছপ ও কাছিম প্রজনন কেন্দ্র, প্রাইমেট হাউজ,
ভালচার হাউজ, লামচিতার ঘর, হাতী শালা, পর্যবেক্ষন টাওয়ার, বুটিং ও লেক জোন, ফুডকোর্ট ও ওয়াশরুম, গোলঘর ও ছাতা, পাবলিক টয়লেট, জিরাফ ফিডিং হাউজ, মেরিন একুরিয়াম, অর্কিড হাউজ, প্রজাপতি বাগান, আভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা, পেলিকেন আইল্যান্ড,
ঝুলন্ত ব্রীজ উল্লেখযোগ্য।
আমরা সাফারি কিংডমে প্রবেশ করতেই হাতের বামে পড়লো বিভিন্ন পাখির
খাচা,
এসব পাখি শুধু দেখার জন্য আমরা মেকাউ ল্যান্ড গেলাম। এখানে পাখির
খাঁচার কাছে যেতেই আমার মেয়ে আনিকা আনন্দে নেচে উঠলো। এখানে দেখা পেলাম নানা
প্রজাতির রং-বেরঙের দেশি-বিদেশি পাখি। আমরা বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। হঠাৎ করে এখানে
এসেই আমার ক্যামেরাটি নষ্ট হয়ে যায়। তাই আর কোন ছবি তুলতে পারিনি।
মেকাউ পাখি দেখছে লেখকের মেয়ে আনিকা, ছবিটি তুলেছেন ইয়াছমিন আমির
|
এখানে দর্শনার্থীদেরকে আনন্দিত করবার জন্য রয়েছে বাটারফ্লাই পার্ক।
আমরা হাতের ডান পাশে বাটারফ্লাই পার্কে প্রবেশ করলাম। সেখানে হরেক রকম প্রজাপতি
দেখলাম। যেখানে প্রতিনিয়ত হয় রঙের উড়াউড়ির খেলা। এখান থেকে বেড়িয়ে সোজা সামনের
দিকে বামে গেলাম। এখানে দেখতে পেলাম কুমির সাফারি পার্ক, আবার ডানে গিয়ে দেখতে পেলাম হাতি, টিকেট করে
হাতিতে উঠা যায়। ছোট বাচ্চারা ভয় পাবে তাই কেউ হাতিতে উঠেনি। আরো একটু সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম লেক। লেকে অনেক
প্রজাতির হাঁস আছে, আছে নৌকা। অনেকেই নৌকায় উঠছে। লেক
ছেড়ে বাম দিকে যেতেই দেখতে পেলাম ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমগ্র সাফারি
পার্কের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যায় পার্কের ভেতর বিচরণরত বাঘ, সিংহ, হাতি, জেব্রা,
জিরাফ, হরিণ ইত্যাদি বন্যপ্রাণী।
টাওয়ারের বামে গিয়ে দেখতে পেলাম ময়ূরের খাঁচা, খাঁচা পার হয়ে বামে গেলাম। আমরা যেতেতু শিশুদেরকে নিয়ে আসছি তাই এখানেই
আসার মূল উদ্দেশ্য। কারণ এখানে আছে শিশু পার্ক। কুমিরের মুখ মার্কা একটি গেইট
দেখতে পেলাম। টিকেট কেটে এই পার্কে ঢুকতে হয়। আমরা সবাই টিকেট কাটলাম। সব
ছেলে-মেয়েরা হই-হল্লোর করে কুমিরের ভেতর দিয়ে শিশু পার্কে প্রবেশ করলো। এখানে আছে
মিনি রোলার কোস্টার, মিনি ট্রেন, নাগর দোলা, স্লাইট,
হাওয়া বিছানা, দোলনা ইত্যাদি। প্রতিটির
জন্য আছে আলাদা আলাদা টিকেট। যার যার পছন্দ মতো রাইডে বাচ্চা ছড়ছে। আমার মেয়ে
আনিকা মিনি ট্রেনে ভ্রমণ করে আনন্দিত হলো। এইবার শিশু পার্ক থেকে বেরিয়ে সামনে
গিয়ে জুলন্ত ব্রিজে গেলাম। ব্রিজ থেকে চলে আসলাম। সামনে গিয়েই দেখতে পেলাম বানরের
খাঁচা, শকুনের খাঁচা। এই সব দেখে সামনে যেতেই দেখতে পেলাম
অস্ট্রিজ যা দেখতে উট পাখির মতোই। আরেকটু সামনে গিয়ে হাতের ডানে দেখতে পেলাম একটি
নিচু খাঁচা, এর ভেতরেই আছে অজগর সাপ। পরের টায় ঘুইসাপ।
পরে কুমিরের খাঁচায় চলে আসলাম।
আরেকটু সামনে যেতেই দেখতে পেলাম হাতের ডানে ন্যাচারেল হিস্ট্রি
মিউজিয়াম (প্রাণীদের মমি করা যাদুঘর)। আমরা ন্যাচারেল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে প্রবেশ
করে ঘুরে দেখলাম। জীববিজ্ঞানের নানা তথ্য ও গবেষণার জন্য রয়েছে ন্যাচারেল হিস্ট্রি
মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির মেরুদণ্ডি ও অমেরুদণ্ডি প্রাণীর
দেহাবশেষ,
স্পেসিমেন ও স্টাফিং সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক
বনাঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা। প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছ-পালার হারবেরিয়াম সিট তৈরী
করে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সাফারী পার্কে ন্যাচারেল
হিস্ট্রি মিউজিয়াম নির্মাণ যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এতে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ বিপদাপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সম্পর্কে
বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারবেন। তাছাড়া ডাটাবেজ হতে শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ
বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সকল প্রকার তথ্য পেতে সমর্থ হবেন।
কোর সাফারী পার্কে বিচরণরত বাঘ, ছবিটি তুলেছেন জনপ্রিয় ফটোব্লগার
আমার প্রিয় বন্ধু কামাল উদ্দিন
|
এখানে আছে প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র। এখানে বাংলাদেশের প্রায় সকল
ধরণের বনাঞ্চলের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর মডেল, মুরাল ও ষ্টাফিং
তৈরী করে আলো ও শব্দধ্বনি প্রবাহের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চল সম্পর্কে
দর্শকদেরকে ধারণা প্রদান করা হয়। প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় ৯৮০ ধরণের
বন্যপ্রাণী ও অসংখ্য গাছ-পালার মডেল মুরাল তৈরী করা হয়েছে। প্রায় ১২ মিনিটের দীর্ঘ
একটি স্বব্যখ্যায়িত অডিও-ভিস্যুয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে দর্শকগণ আনন্দ লাভ করতে
পারবেন।
এখানে ৯৬৫ একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে বিরল, বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্ন প্রজাতির গাছের জিনপুল সংরক্ষণের জন্য
বায়োডাইভারসিটি পার্ক। এই পার্ক প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিরল, বিলুপ্তপ্রায়, দূলর্ভ ও বিপন্ন প্রজাতির গাছের
জীন-পুল সংরক্ষণ করা। এছাড়া এ পার্কে শালবন এবং জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্তে
উপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে।
এশীয় তৃণভোজী এবং ছোট মাংসাশী প্রাণী, পাখি
সরিসৃপ ও উভয়চর প্রাণী নিয়ে ৮২৪ একর জমির ওপর এক্সটেনসিভ এশিয়া সাফারি প্রতিষ্ঠিত।
এ ছাড়া বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ প্রায় ১৫০ একর জায়গায় তৈরি করা হয়েছে হাতির আশ্রম। এই
পার্কে সকল এশীয় তৃনভোজী এবং ছোট মাংসাশী প্রাণী, পাখি,
সরিসৃপ ও উভচর প্রাণী নিয়ে এক্সটেনসিভ সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠা
করা হয়েছে।
এই পার্কে অবমুক্ত ও বেস্টনিতে রাখা বন্যপ্রাণীদের মধ্যে আছে, বাঘ, সিংহ, হাতি,
জিরাফ, জেব্রা, ওয়াইল্ডিবিস্ট, ব্লেসবক, ভাল্লুক, গয়াল, চিত্রা
হরিণ, মায়া হরিণ, প্যারা হরিণ,
সাম্বার, মিঠা পানির কুমির, নোনা পানির কুমির, শকুন, অজগর, গুইসাপ, ইমু
পাখি, উট পাখি, ময়ূর, রাজ ধনেশ, কাক ধনেশ, ম্যাকাউ,
টিয়া, গ্রে-প্যারট, সোয়ান, বিভিন্ন জাতের কাছিম ও কচ্ছপ, গোল্ডেন ফিজেন্ট, সিলভার ফিজেন্ট, এবানর, হনুমান উল্লেখযোগ্য।
আমরা সাফারী পার্ক পরিদর্শন শেষে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এদিকে
বেলা ৫:০০ বেজে গেছে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে তারপর গেইট দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
পরে গাড়ীতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক এর ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন