আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা
দিবস, বিজয় দিবস, ক্রীড়া
ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান
অধিকারকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে তাদেরকে দেয়া হয় থালা-বাটি বা
সিরামিকের অন্য কিছু। এটা আমার কাছে কেমন জানি বেমানান লাগে। আমরা কি পারি না
শিক্ষার উপকরণ হিসেবে অন্তত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থালা-বাটি বা সিরামিকের
পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী বই দিতে?
আমরা জানি, শিক্ষাই
জাতির মেরুদণ্ড, আর
শিক্ষার বিকাশে বইয়ের বিকল্প নেই। জীবসত্তার ঘর থেকে মানব সত্তার ঘরে উঠবার মই
হচ্ছে শিক্ষা, আর
শিক্ষার বাহক হচ্ছে বই। বই মানুষের হৃদয়কে সুন্দর ও জীবনকে করে সমৃদ্ধ। আর সমৃদ্ধ
হৃদয়ের মানুষেরাই পারে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে। বই পড়ে হৃদয়কে সমৃদ্ধ করার
মাধ্যমে দেশকে উন্নত করা যায়। বই পড়লে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। মনের ভিত্তি শক্ত হয়।
এর ফলে যেকোন সংকট মোকাবিলা করা সহজ হয়। মানুষ বই পড়েই নিজেকে জানতে পারে এবং
নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে।
একটি ভালো বই মানুষকে সু-পথ দেখায়। যেকোনো সময় যেকোনো মানুষকে বদলে
ফেলতে পারে। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকশিত করে তাকে দায়িত্ব সচেতন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকে
পরিণত করে। সে জন্য বই হচ্ছে মানুষের উৎকৃষ্ট বন্ধু। মানবজীবনে বই এক পরম বন্ধু।
জীবনের বন্ধ দরজা-জানালাগুলো খুলে দেওয়ার জন্যে বইয়ের বিকল্প নেই। বইয়ের পাতায়
সঞ্চিত থাকে হাজার বছরের সমুদ্র কল্লোল। অতীত এবং বর্তমানের অনন্য সেতুবন্ধন হলো
বই। বই হলো আলোর কারখানা। বই শিশু-কিশোরদেরকে স্বপ্ন বুনতে শেখায়।
বড় মনের মানুষ হওয়ার জন্য সবাইকে বইয়ের সান্নিধ্যে আসতে হবে। বড়
মানুষ হতে হলে স্বপ্ন বুনতে হবে। বেশি করে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বই পাঠে
আনন্দ আসে, মানসিক
পরিবর্তন ঘটে, উন্নত
ধ্যান ধারণা জন্মায়। আপন জগতকে চেনা যায়। অপরাধবোধ কিংবা অপচিন্তা দূর করা যায়।
একসময় বই পাঠের প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অতি
আকর্ষণে অনেকেই মোবাইল, ইন্টারনেটের
অপব্যবহার করছে। নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে বইয়ের প্রতি। ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি
তরুণ সমাজের মাঝে অপসংস্কৃতি ও মাদকাসক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বই যে
সর্বশ্রেষ্ঠ বিনোদনের মাধ্যম, বিষয়টা
তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষার
একটি অন্যতম পথ হলো তাদেরকে বইমুখি করা। এই অপব্যবহার রোধ করতে বইয়ের কোন বিকল্প
নেই।
শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য মানসিক বিকাশ। যদিও আমাদের দেশে শিক্ষার হার
বাড়ছে, কিন্তু আশানুরূপ মানসিক
বিকাশের প্রতিফলন ঘটছে না। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে জ্ঞান আহরণের সুযোগ সীমিত। এ দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের
জ্ঞানের পরিধি শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষের পাঠ্য বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ
শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে এসে জ্ঞান আহরণের জন্য সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক বই
পাঠ করার সুযোগ নেই বললেই চলে।
ভালো মানের একটি বই পারে একটি শিশুর মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে। আর
মানসিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই
শিশু-কিশোর-শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে তাদের হাতে বই তুলে দেওয়া দরকার। মাদক, সন্ত্রাস, নেশা, দুর্নীতি, খুন
নিয়ে জাতি আজ উদ্বিগ্ন। ফলে জাতি হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াবে কার ওপর ভর করে? এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়
হচ্ছে শিশুকাল থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর সেটা করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
থেকেই।
পৃথিবীর সকল উন্নত দেশগুলোতে বই পড়ার ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়। যা
আমাদের দেশে দেওয়া হয় না। আমরা আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদেরকে পুতিগত বিদ্যা
শিখাচ্ছি। এর বাইরে তারা কিছু জানে না। এই জগত সর্ম্পকে তাদের অনেক কিছুই অজানা
থেকে যায়। সুস্থ, সুন্দর
ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ
ঘটায়, মননশীলতার সম্প্রসারণ ও
জ্ঞানের গভীরতা বাড়ায়।
ঘরের শো-কেসের অন্যান্য সামগ্রীর চেয়ে বইয়ের সৌন্দর্যই ঘরকে আলোকিত ও
সৌন্দর্যমণ্ডিত করে বেশি। বই একদিকে পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ উপাদান অন্যদিকে জাতি গঠনের
শ্রেষ্ঠ আধার হিসেবে কাজ করবে। বই পড়ে শিশু-কিশোররা নির্মল আনন্দ উপভোগ করবে।
সুন্দর মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে। তাই প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা
দিবস, বিজয় দিবস, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক
প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ও পরীক্ষায় ভালো
ফলাফলের জন্যে একমাত্র পুরস্কার হোক বই, থালা-বাটি নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন