রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

গ্রন্থ পর্যালোচনা: ‘অপরাজিতা’



“এই অবাক হওয়া মানুষগুলোর কাছে চিরদিনই এটা রহস্য থেকে যাবে, কেনো দু’জন ভিনদেশি যুবক-যুবতি এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে তাদের দেশে এসে। কে জানে কিছু রহস্য থাকা হয়ত ভালোই। কারণ প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে!”
বইয়ের ধরন: উপন্যাস

বইয়ের নাম: অপরাজিতা

লেখক: আসাদুজ্জামান খান

প্রকাশক: প্রকৌশলী শামিম রহমান আবির
কুঁড়েঘর প্রকাশনী লিমিটেড
৮২, কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স
২৫৩-৫৪, কুদরত-ই-খোদা রোড, কাঁটানবন, ঢাকা-১২০৫।
প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬
গ্রন্থস্বত্ব: লেখক
প্রচ্ছদ: জাহেদুর রহমান রবিন 
মূল্য: ২০০ টাকা
ফন্ট সাইজ: ১২
পৃষ্ঠা: ৮০
ফর্মা: ৫
ISBN: 978-984-92092-8-7


প্রকাশক প্রকৌশলী শামিম রহমান আবির কর্তৃক কুঁড়েঘর প্রকাশনী লিমিটেড থেকে একুশে বইমেলা-২০১৬ তে প্রকাশিত হয় তরুণ ঔপন্যাসিক আসাদুজ্জামান খানের প্রথম উপন্যাস ‘অপরাজিতা’। উপন্যাসটি পাঁচ ফর্মায় (৮০ পৃষ্ঠা) চার রঙা প্রচ্ছদে ছাপানো হয়েছে। একটি বইয়ের প্রাথমিক সফলতা নির্ভর করে এর চমৎকার বাঁধাই এর উপর। ‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের বাঁধাই ছিল খুব সুন্দর ও নিঁখুত। উপন্যাসটি স্পষ্ট ছাপার অক্ষরে ১২ ফন্টে ১০০ গ্রাম অফসেট কাগজে বাঁধাই করা করা হয়। যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।


‘অপরাজিতা’ লেখকের অতি পছন্দের উপন্যাস। অতি পছন্দের জিনিস অতি পছন্দের কাউকে উৎসর্গ করতে হয় তাই তিনি তাঁর চার মাসের অতি আদরের কন্যা আফরাকে উৎসর্গ করেই এই উপন্যাসের যাত্রা শুরু করেন। উক্ত উপন্যাসের কাহিনীটা সহজ-সরল-সাবলিল ভাষায় নির্ভুল বানানে সব শ্রেণী পাঠকের উপযোগী করে লেখা হয়েছে। লেখক এ উপন্যাসটিকে ১৬টি অধ্যায়ে ভাগ করে অতি যত্নের সহিত কাহিনিটা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। প্রতিটি অধ্যায় পড়ার পর পাঠক পরবর্তী অধ্যায় পড়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকবে কি ঘটছে উপন্যাসের গল্পকথক জেবুন্নাহারের জীবনে জানার জন্য। 


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসে লেখক একটি কালো মেয়ের সংগ্রামী জীবন ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের ভাষায়। খুব কঠিন শব্দ বা বাক্য নেই। নেই মাথা এলোমেলো করে দেওয়ার নীতিবাক্য। অন্যরকম একটি কাহিনী নিয়ে উপন্যাসটি তৈরি হয়েছে। তাই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠককে কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। আমার বিশ্বাস উপন্যাসটির শেষ লাইন পর্যন্ত যারা পড়বে তাদের কোন না কোন লাইনে এসে নিজের অজান্তেই চোখের কোনা গড়িয়ে জল পরবেই। এক গভীর মমতা জন্মাবে নি:সঙ্গ গল্পকথক জেবুন্নাহারের প্রতি। পুরোটা সময় পাঠককে আটকে রাখবে উপন্যাসের পাতায় পাতায়।


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের সবচাইতে শক্তিশালী দিক হলো তার কাহিনীর ধারাবাহিকতা। লেখক তাঁর উপন্যাসে একটি মেয়ের জটিল চিন্তার যে পরিস্কার চিত্র প্রকাশ করেছেন তা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ‘অপরাজিতা’ একজন কালো মেয়ে সমাজে প্রতিকুল পরিবেশে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। এতো প্রতিকুলতার পরও হার না মেনে জেবুন্নাহার অপরাজিতা হয়ে সমাজে টিকে থাকে। 

‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের দুর্বল দিক হলো সুরভী চরিত্রের দুর্বলতা। জেবুন্নাহারের জীবনে সুরভী একটি বিরাট ভূমিকা রাখলেও উপন্যাসে সুরভীর চরিত্রটির পদচারনা খুব সামান্য। লেখক এই চরিত্রটিকে নিয়ে উপন্যাসের মূল ঘটনার সাথে মিল রেখে কাহিনীটাকে আরো প্রানবন্ত করতে পারতেন। গল্পের নায়ক গিরিশ চন্দ্র সেন। খুব অল্প সময়ে গিরিশের বিচরণ লক্ষ করলাম। তাকে নিয়ে আরো বিস্তারিত লেখা যেত।

‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের প্রচ্ছদটি এককথায় বলতে গেলে দারুন হয়েছে। এমন আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ সচরাচর কম বইয়েই পাওয়া যায়। এর সকল কৃতিত্বই প্রচ্ছদ শিল্পী জাহেদুর রহমান রবিন এর। আপনি যদি কোনো একটা লাইব্রেরীতে গিয়ে শুধু এর কভার পেজটি দেখেন তখন আপনার ইচ্ছে করবে বইটি একটু উল্টে পাল্টে দেখতে। আর আপনি যখন বইটি উল্টে পাল্টে দেখবেন তখনই আপনার মনে বইটি কিনে ফেলার একটা আগ্রহ জন্মাবে। আর আমি মনে করি যেকোন লেখকের জন্য এটাই হচ্ছে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন।


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসটির নামকরণ আমি বলবো পুরোপুরি ভাবেই সার্থক। যদিও এই বইটি আমার পড়া সেরা বইয়ের মধ্যে পড়বে না, তারপরও জোড় গলায় বলতে পারি অনেক উপন্যাসগুলোর চাইতেও এর নামকরণ অনেক ক্ষেত্রেই সার্থক। কাহিনীর সাথে নামের যথেষ্ট মিল আছে। উপন্যাসের নাম দেখে অনুমান করা যায় গল্পটি কেমন হবে। নাম দেখেই সহজে পাঠক এ উপন্যাসটির প্রতি আকৃষ্ট হবে।


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের পুরো ফ্রেমই আপনি দেখতে পাবেন জেবুন্নাহারের চোখ দিয়ে। অর্থ্যাৎ তার দেখা আর উপলব্ধি করা বিষয়গুলোই অপরাজিতা উপন্যাসের বেশিরভাগ জুড়ে আছে। তার চোখ দিয়ে উপন্যাসের বাকি চরিত্রগুলো ফুটে উঠেছে। সেটা সাদেকুরের জীবনই হোক, মুকুর জীবনই হোক বা পরীবানুর গল্প হোক না কেন। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় আপনাকে নিয়ে যেতে থাকবে সামনের দিকে... 


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের সারসংক্ষেপ: 

জেবুন্নাহার হচ্ছে এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আর একই সাথে গল্পকথক। নিতান্তই সাধারণ গোছের একজন মেয়ে। এক ভাই, দুই বোন, বাবা-মা ও দাদীকে নিয়ে তাদের সংসার। খুব সাজানো গুজানো সুন্দর একটি পরিবার। যে পরিবারে নেই কোন অশান্তি। তার মায়ের গায়ের রঙ উজ্জল শ্যামলা। বাবার গায়ের রঙ ময়লা। আর ছোট বোন মুকুর গায়ের রঙ একদম ফর্সা। কিন্তু সে এ পরিবারের একমাত্র কালো মেয়ে। কালো বলে তার বিয়ে হয় না। ছেলেরা তাকে পছন্দ করে না। তাই সে আক্ষেপ করে বলে, “পৃথিবীর সবাই সুন্দরী একমাত্র আমি ছাড়া। আমি যদি ফর্সা সুন্দরী একটা মেয়ে হতাম তাহলে কি ক্ষতি হয়ে যেত কারও?”


জেবুন্নাহার এর সাজানো সুন্দর পরিবারে হঠাৎ করেই নেমে আসে এক কালবৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার একমাত্র বড় ভাই সাদেকুর। তার বাবার ইচ্ছে ছিল সাদেকুরকে ডাক্তার বানাবেন কিন্তু সে সবসময় কবিদের মতো ভাবুক ছিল। বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে না পারায় মনের দু:খে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সাদেকুর। তার কিছুদিন পরই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় জেবুন্নাহারকে। এ পৃথিবীতে যাকে বেশি ভালোবাসত সে হলো তার বাবা। সেই ভালোবাসার মানুষ বাবা তাকে ও তার পরিবারকে কষ্ট দিয়ে ত্রিশ বছরের বছরের সংসার ধর্ম ত্যাগ করে দূর সর্ম্পকের এক খালাত বোনের হাত ধরে চলে যায়। এত কষ্টের মাঝেও ভেঙ্গে পড়েনি জেবুন্নাহার। বাবা চলে যাওয়ার পর দাদী পরী বানুর মৃত্যু হয়। আস্তে আস্তে প্রিয় মানুষগুলো তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। 

পাঁচ বছর পর হঠাৎ সাদেকুর সাকু সন্ত্রাসী হয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়িতে আসার একদিন পরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ভাই গ্রেফতার হওয়ার পরপরই একের পর এক বিপদ তাদের সামনে হাজির হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়াটি চলে যায়। এর কিছুদিন পরই তাদের এলাকার এক পলিটিশিয়ান এসে তাদের বাড়ি দখল করে নেয়। বাধ্য হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠতে হয়। বাবা চলে যাওয়ার পর বাসা ভাড়া দিয়ে যা পেতো তা দিয়ে তাদের সংসার চলতো। এখন বাসা ভাড়া নেই। উল্টো তাদেরকে বাসা ভাড়া দিতে হবে। মা ও ছোট বোন মুকুর কথা চিন্তা করে চাকুরি সন্ধান করে।

জেবুন্নাহারকে একটি চাকুরির জন্য বান্ধবী সানজিদা সুরভীর সাহায্য নেয়ার কথা বললো। বান্ধবীর কথামতো সুরভীর খোঁজে এসে পড়ে আরেক ভয়ঙ্কর বিপদে। যেই বিপদ তার জীবন সংসারকে ওলটপালট করে দেয়। যার জীবনে চলে আসে গিরিশ চন্দ্র সেন! সিদ্ধিলাভের জন্য গিরিশ চন্দ্র সেন দীর্ঘদিন যাবত একজন কালো মেয়ে খুঁজছিলেন। জেবুন্নাহারকে দেখে তার ভালো লেগে গেল। সেই থেকে তার পিছু নিয়েছেন এই গিরিশ চন্দ্র সেন। এক সময় তার উদ্দেশ্য হাছিল করে জেবুন্নাহারকে রেখে চলে যায়। শুরু হয় জেবুন্নাহারের সংগ্রামী জীবন। গিরিশের সন্তান পেটে নিয়ে সমাজের নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হয় তাকে। এত কিছুর পর জেবুন্নাহার হার মানেনি। হার না মানা অপরাজিতা এক নারীর নাম জেবুন্নাহার। গিরিশের সন্তান পেটে ধারণ করার কিছুদিন পরই তার জীবনে হঠাৎ করেই পরিবর্তন আসে। তাদের বাড়িটা ফিরে পায়। পূর্বের ভাড়াটিয়া ফিরে আসে। তার ভাই র‌্যাবের ক্রফায়ারে মৃত্যুবরণ করে বাসায় ফিরে আসে। এ সব কিছুই একটা রহস্যের মধ্য দিয়ে চলে। এইসব রহস্য উদঘাটন করতে হলে পাঠককে পড়তে হবে ‘অপরাজিতা’। এভাবেই এগিয়ে চলে আসাদুজ্জামান খানের প্রথম উপন্যাস ‘অপরাজিতা’।


লেখক পরিচিতি:

তরুণ উপন্যাসিক আসাদুজ্জামান খান ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানায় ভাষা শহীদ রফিক নগরে অবস্থিত নানা বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। মা রেহেনা বেগম একজন গৃহিনী। বাবা মরহুম আকতার হোসেন খান। স্ত্রী সানজিদা খান আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে আফরা।

তিনি ইউনিভার্সিটি অব ইনফর্মেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্সেস (ইউআইটিএস) থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ফকিরাপুলে প্রেসের ব্যবসা করেন।
আসাদুজ্জামান খানকে জীবনের এই স্বল্প সময়ে নানান ধরনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বার বার। লেখক নানামুখি চাপে যখন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল ঠিক তখন এক দুর্যোগময় সময়ে দেখা মিলে শ্রদ্ধেয় গুরুজী শহীদ আল বোখারী’র। যার শেখানো মন নিয়ন্ত্রনের রাস্তায় হেঁটে জীবন অনেক সহজ হয়েছে লেখকের। অর্জিত হয়েছে কোন ধরনের অসহযোগী পরিস্থিতিতে হেসে দেয়ার এক বিরল সৌভাগ্যের। জীবনের মূল মন্ত্র, সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন। যা শ্রদ্বেয় গুরুজীর কাছ থেকে প্রাপ্ত। অদ্ভুত হলেও সত্য, গুরুজীর কাছ থেকে মন নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা নেয়ার পর থেকেই আসাদুজ্জামান খানের লেখালেখির যাত্রা শুরু। যা এখনও অব্যহত আছে। আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে। 

এ পর্যন্ত তাঁর তিনটি বই প্রকাশ হয়েছে। সুনীল বাবুর এক টুকরো সুনীল আকাশ (গল্পগ্রন্থ) ২০১৩ ইং, অশান্ত বসন্তের ফুল (গল্পগ্রন্থ) ২০১৪ ইং, অপরাজিতা (উপন্যাস) ২০১৬ ইং

পরিশেষে বলবো, আমার জীবনে যতগুলো উপন্যাস দাগ কেটেছে তার মধ্যে অপরাজিতা অন্যতম। আমি ‘অপরাজিতা’র কারিগর আসাদুজ্জামান খানের মধ্যে ভবিষ্যত হুমায়ুন আহমেদকে দেখতে পাচ্ছি। বাংলা সাহিত্যে একজন চমৎকার ঔপন্যাসিকের জন্ম হয়েছে। এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব পাঠকের। পাঠক যদি এই ঔপন্যাসিকের যথাযথ মূল্যায়ন করেন তাহলে বাংলা সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হবে। 


‘অপরাজিতা’ উপন্যাসের অনলাইন লিংকসমূহ:

কোন মন্তব্য নেই: