টুনটুনি পাখিকে বলা হয় বাসা তৈরির কারিগর। সূঁচের মত ধারালো ঠোট দিয়ে শৈলিক বুননে টুনটুনি তৈরি করে
তার নিজের বাসা। ছোট্ট পাখি টুনটুনির দৃষ্টিনন্দন এই বাসা
দেখে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আসলে এর কারিগর কিন্তু টুনটুনিই। এখন আর আগের মত
টুনটুনির বাসা চোখে পড়ে না। আগের আর টুনটুনি আমাদের আশে পাশে দেখতে পাই না। আগের
মত টুনটুনির ডাক শোনা যায় না। বন, জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড় কমে যাওয়ায় ক্রমশ কমে যাচ্ছে আমাদের অতিচেনা ছোট্ট পাখি
টুনটুনি। টুনটুনিকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন- নীল টুনটুনি, বেগুন টুনটুনি, মৌটুসকি, মধুচুষকি, দূর্গা টুনটুনি, মধু চমকি, মৌটুসি।
টুনটুনির ইংরেজী নাম Common
tailorbird অর্থাৎ দর্জি পাখি।
এরা গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে বাসা তৈরি করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Orthotommus
sutoriu. টুনটুনি (Tailorbird)
Sylviidae পরিবারের অর্ন্তগত Orthotomus গণের অর্ন্তভুক্ত। টুনটুনি বাংলাদেশের অত্যন্ত সুপরিচিত একটি পাখি। ইহা জলপাই সবুজ বা
হলদে সবুজ বর্ণের ক্ষুদ্রাকৃতির পোকা শিকারী পাখি। তবে শারীরিক ও স্বভাবগত বিভিন্ন
বৈশিষ্ট্যাবলীর পার্থক্যের ভিত্তিতে তিনটি পৃথক পৃথক নামে এদের বর্ণনা করা হয়।
এগুলো হলো কালাগলা টুনটুনি, পাহাড়ি টুনটুনি ও পাতি
টুনটুনি। পৃথিবীতে ১৫ প্রজাতি টুনটুনি থাকলেও বাংলাদেশে এর তিনটি প্রজাতি রযেছে। বর্তমানে তাও বিলুপ্তির
পথে।
কালাগলা টুনটুনি (Orthotomus
atrogularis): প্রাপ্ত বয়স্ক পাখির পিঠ জলপাই সবুজ;
মাথার চাঁদি লালচে; ডানার বাঁক
অপেক্ষাকৃত হলুদ; এবং গাল ধূসরাভ। ছেলেপাখির গলা ও ঘাড়ের
পিছনটা লম্বা দাগসমেত কালচে এবং মেয়ে পাখিতে কয়েকটি লম্বা দাগ নিয়ে ফিকে
ধূসরাভ। এর বুক ও পেট সাদাটে; লেজতল-ঢাকনি হলুদ; চোখ কমলা-বাদামি; এবং পা ও পায়ের পাতা মেটে।
এর দীর্ঘ সোজা ঠোঁট দুরঙের: উপরের ঠোঁট বাদামি ও নিচের ঠোঁট ফিকে মেটে-বাদামি। কালাগলা
টুনটুনি সাধারণত প্রশস্ত পত্রবহুল চিরসবুজ বনের প্রান্তদেশ ও মধ্যস্থিত ঘন ক্ষুদ্র
ঝোপ এবং বাঁশঝাড়ে বিচরণ করে; এরা কর্মচঞ্চল, দিবাচর পাখি।
খাদ্য তালিকায় রয়েছে ছোট পোকা ও লার্ভা। অভ্যাসবসত পিঠে লেজ উঠিয়ে জোরে ডাকে। কালাগলা
টুনটুনি বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি; চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের
চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়।
[কালাগলা টুনটুনি]
পাহাড়ি টুনটুনি (Orthotomus
cuculatus): প্রাপ্ত বয়স্ক পাখির পিঠ জলপাই-সবুজ;
কপাল, ডানা ও লেজ লালচে; মাথার চাঁদির সামনের অংশ ছায়ার মতো তবে ঘাড়ের পিছনটা অপেক্ষাকৃত ধূসর;
চোখের পিছনের খাটো ভ্রু-রেখা সাদা-হলদে; চোখের ডোরা কালচে; কান-ঢাকনি, গলা ও বুক ধূসর; এবং পেট ও লেজতল-ঢাকনি
উজ্জ্বল হলুদ। এর চোখ বাদামি; পা ও পায়ের পাতা সামান্য বাদামি-মেটে;
সোজা ঠোঁট দুরঙা: উপরের ঠোঁট কালো ও নিচের ঠোঁট কমলা গোড়াসহ শিঙ-রঙা।
এর পরিষ্কার বৈশিষ্ট্য হলো পেট উজ্জ্বল হলদে। পাহাড়ি টুনটুনি একটি প্রাণবন্ত পাখি;
মিশ্র ঝোপসহ চিরসবুজ বনের বৃক্ষতলে উৎপন্ন গুল্মলতা ও বাঁশে
এরা বিচরণ করে। ঝোপঝাড়ে অতি ক্ষুদ্র পোকা শিকার করে ও প্রায়ই আকাশে ওড়ে
পোকা-মাকড় ধরে। চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ পাহাড়ি বনে পাওয়া যায়।
[পাহাড়ি টুনটুন]
পাতি টুনটুনি (Orthotomus sutorius): পাতি টুনটুনি
সাধারণত বনের ধার, ক্ষুদ্র ঝোপ, নিচু
অঞ্চলের বাগান ও পাহাড়ের ১৮০০ মিটার পর্যন্ত উচুতে বিচরণ করে। জোড়া কিংবা
পারিবারিক দলে গ্রাম, পতিত জমি, ঝোপ
ও বনের ধারে খাবার খোঁজে। আম্রকুঞ্জে সর্বদা যাতায়াত করতে পছন্দ করে; পত্রগুচ্ছের আড়ালে থেকে পোকা শিকারের জন্য ডাল থেকে ডাল বিদ্ধ করে
চলে।
[পাতি টুনটুন]
পাখিদের মধ্যে বাবুই পাখিকে ‘আর্কিটেক্ট’
পাখি বলা হলেও টুনটুনির নির্মাণ শৈলী সম্পূর্ণ আলাদা। আকারে ছোট
এই পাখিটিকে আসলে যতটা চালাক ভাবা হয় বাস্তবে তা নয়। এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালবাসে। এরা খুবই চঞ্চল। সারাক্ষণ ওড়াউড়ি করে দুরন্ত
বালকের মতো। ওড়ার সময় পিঠের ওপরের লেজ নাড়িয়ে টুই টুই শব্দ করে উড়ে বেড়ায়। চোখে না
দেখলে এই পাখির ডাক শুনে মনেই হবে না এরা এতই ছোট। এদের ডাক খুব তীব্র এবং অনেক
দূর থেকে শোনা যায়। চঞ্চল স্বভাবের টুনটুনি এক জায়গায় কখনও স্থির থাকে না। ছোটাছুটি করে সময়
কাটায়।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এরা ঠোঁট দিয়ে গাছের পাতা সেলাই করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চমত্কার
বাসা তৈরি করে। এ জন্যই টুনটুনিকে দর্জি পাখি বলা হয়। এরা সাধারণত ছোট-মাঝারি উঁচু
গাছের পাতায় অথবা ঝোপ-ঝাড় জাতীয় গাছ যেমন লাউ, কাঠ বাদাম,
সূর্যমূখী, ডুমুর, লেবু, মেহগনি এরকম গাছের পাতায় বাসা বাঁধতে
পছন্দ করে। তবে
টুনটুনি ডুমুর গাছে সব থেকে বেশী যে গাছে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। গাছের অপেক্ষাকৃত
বড় যে পাতা থাকে তাতে লম্বা-গোল চৌকা আকৃতির ছাউনির মত করে বাসা তৈরি করে টুনটুনি
পাখি। এদের বাসা খুব বেশি উঁচুতে হয়না। সাধারনত এরা ৬-১০
সেমি উচ্চতায় বাসা বাধে। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি মিলে বাসা তৈরী করে। অনেক সময় নিচু জায়গায় বাসা তৈরি করায়
বন্য প্রাণির আক্রমন করে ছানা বড় হওয়ার আগেই খেয়ে ফেলে। আবার পাতা গাছ থেকে ঝড়ে
ডিম বা বাচ্চাসহ মাটিতে পড়ে যায়। ছোট ছেলে-মেয়েদের টুনটুনির বাসার প্রতি থাকে
তীব্র আকর্ষণ। তারাও দুষ্টমি করে বাসা বিনষ্ট করে বাচ্চা নিয়ে যায়। এভাবেই কমে যাচ্ছে টুনটুনি।
স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে গাছের বড় ২/৩ টি পাতা
দিয়ে সেলাই করে বাসা তৈরি করে। একটি বাসা তৈরি করতে একজোড়া টুনটুনি দম্পতির
সময় লাগে চার থেকে পাঁচদিন। এরা পাখির পালক, গরুর লেজের চুল, লতা, তুলা, সুতা
মিশিয়ে দৃষ্টিনন্দন বাসা বানায়। টুনটুনির বাসা বাঁধা
ও প্রজনন মৌসুম বছরের ফাল্গুন মাস থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে। বাসা তৈরি শেষ হলেই ৩/৪
টি ডিম পাড়ে টুনটুনি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে ডিমে তা দিয়ে ১০ দিনের মধ্যে ছানা ফুটায়।
আর দশ দিনের মধ্যেই ছানাসহ বাসা ত্যাগ করে টুনটুনি। প্রতি প্রজনন মৌসুমে টুনটুনি
দম্পতি ২/৩ বার ডিম দিয়ে ছানা ফুটায়। এ সময় কেউ
টুনটুনির বাসার কাছে গেলে স্বামী-স্ত্রী মিলে টুই টুই শব্দ আর ওড়া-উড়ি করে ছানাদেরকে
সুরক্ষা দিতে বিশেষ তৎপর হয়ে পড়ে।
এমন দৃষ্টি নন্দন সুন্দর টুনটুনি দিন দিন আমাদের
কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন বন জঙ্গলের গাছেও তেমন টুনটুনি পাখি চোখে পড়েনা।
গ্রামের নানা বয়সী পাখি শিকারীরা গুলতী নিয়ে সারাদিন পাখি শিকারের নেশায় ঘুরে বেড়ায়। শিকারীরা ব্যবহার করে মারভেল, ইটের কনা। কিন্তু ব্যাপক হারে শিকার ও বনভূমির পরিমাণ কমে
যাওয়ায় টুনটুনি পাখিও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষি ক্ষেত্রে অধিক কীটনাশক ও রাসায়নিক
সার ব্যবহারের ফলেও পাখি কমছে। এ ব্যাপারে সরকারীভাবে প্রকল্প গ্রহণ করলে দেশীয় এই
ছোট্ট টুনটুনি পাখি রক্ষা পাবে। অন্যথায় দিন দিন বিলুপ্তির পথে ধাবিত হবে।
তথ্য সূত্র:
দৈনিক ইত্তেফাক, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
রচনাকাল:২৮/০১/২০১৫খ্রি:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন