এক
শরতের পড়ন্ত বিকেল। রোদের ত্যাজ আস্তে আস্তে কমে আসছে। এতক্ষণ সূর্যটা পশ্চিম আকাশে থালার মতো আকার ধারণ করে অবস্থান করছে। একটু পড়েই হয়তো রক্তিম সূর্যটা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে চলে যাবে তার নিজস্ব রাজ্যে। তখন হয়তো কেউ তাকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারবে না।
পলাশ সবেমাত্র গ্রাম থেকে গুলিস্তান আসল। বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা খালী টেম্পু দেখতে পেল। টেম্পুর ড্রাইভারকে হাতে ইশারা করতেই তার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর পলাশ টেম্পুতে আরোহন করে ধানম-ি আসলো। সামনে চারতলা বিল্ডিং দেখলেই পলাশ ড্রাইভারকে ইশারা করল, টেম্পু থামানোর জন্য। টেম্পু থামলেই ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করে দিল। পলাশ মিনিট খানেক দাঁড়ালো। এতদূরে জার্নি করে আসতে খুবই কান্ত লাগছে তার। সাবুর দানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম তার কপালে জমা হলো। ত্যাজহীন নরম কোমল রোদ এসে সেই ঘামের উপর পড়ে চিক্ চিক্ করছে। পলাশ পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘামটা মুছে নিল। সে চারপাশে চোখ ঘুড়িয়ে বাড়িটি ভালো করে চিনে নিল। নিশ্চিত হয়ে দু-এক কদম এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল টিপল।
রায়হান চৌধুরী বাসায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর একটা স্বভাব খবরের কাগজের আনাচে কানাচে যা কিছু লিখা আছে তা খুঁটিয়ে পড়া। তাইতো বিকেল বেলাও খবরের কাগজ পড়ছে। অবশ্য এটা ভাল।
কেয়া তার রুমে শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাস বই পড়ছিল। আজকাল কেয়া উপন্যাসের অন্ধভক্ত হয়ে গেছে। কোন উপন্যাস হাতের কাছে পেলে তা শেষ না করে উঠে না। আর যদি হয় তার প্রিয় লেখকের তাহলেতো কোন কথাই নেই।
কলিং বেলের আওয়াজ রায়হান চৌধুরীর কানে আসতেই কেয়াকেই ডাকছে, কেয়া. এই কেয়া দেখতো কে আসছে?
এ মুহূর্তে রায়হান চৌধুরীর আদেশটা কেয়ার কাছে বিরক্ত লাগছে। এ মুহূর্তে উপন্যাস বইটা ছেড়ে তার উঠতেই ইচ্ছে করছে না। মনে মনে বলতে ইচ্ছে করলে বাবা তুমি তোর পার দরজাটা খুলে দিতে, আমাকে কেন অযথা বিরক্ত করছো।
অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেয়াকে উঠতে হলো। সে দু’তলা থেকে র্ত র্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসল। দরজার সামনে এসেই ভাবতে লাগল, এ মুহূর্তে কে আসতে পারে। আমাদের নিকট কোন আত্মীয়তো আজ আসার কথা না। এসব ভেবে লোকটিকে দেখার জন্য জানালা খুললো কেয়া। দেখতে পেল একটা যুবক কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর উপরের দিকে হা করে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। আহ! বেচারা মনে হয় জীবনে ঢাকা শহর দেখেনি। বয়স আঠার কি ঊনিশ হবে। পরনে কালো জিন্সের প্যান্ট ও সবুজ কালারের একটি শার্ট।
কেয়া আস্তে আস্তে দরজা খুললো। ওকে দেখার সাথে সাথে পলাশের মনে এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠলো। মনে হয় যেন এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনে কখনো দেখেনি। এটা তার প্রথম অভিজ্ঞতা। মুহূর্তে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে গিয়ে কেয়ার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পলাশ। এই হরিণ কালো মায়াবী চোখ দুটি যেন তাকেই কাছে টানছে। এই চাঁদকে দেখার জন্যই হয়তো তার ঢাকায় আগমন। কেয়াও বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো বা সেও জীবনে আঠারটি বসন্ত পার করে দিয়েছে এমন একটা যুবকের সাক্ষাতের জন্য। কিছুতেই যেন দু’জন দু’জনার দৃষ্টি থেকে চোখ নামাতে পারছে না। চার চোখের মিলন হলো। ঠিক ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ ছবির সেই গানটির মতোই ‘পরে না চোখের পলক’। এ অবস্থায় কতক্ষণ যে কেটে গেছে তা বলা মুশকিল। কি ভয়ানক চাহনী! মনে হয় যেন একে অপরকে খেয়ে ফেলবে।
কেয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো, কি ব্যাপার, হা করে তাকিয়ে কি দেখছেন? বাড়ি কোথায়? কোথা থেকে আসলেন? কাকে চান?
পলাশ হঠাৎ চমকে উঠলো। থতমত খেয়ে মাথা নিঁচু করে বললো, দেখুন আপনি কিন্তু এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলছেন? কোন টা রেখে কোনটার উত্তর দেব?
তাতে কি হয়েছে? এবার একটা একটা করে জবাব দিন।
তার আগে বলুন এটা কি রায়হান চৌধুরীর বাড়ি?
হ্যাঁ। কেন?
রায়হান চৌধুরী আমাকে আজ আসতে বললেন। তাই আসলাম।
কেন আসতে বললেন?
আমাকে ওনার বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
কেয়া এবার লজ্জা পেয়ে বললো, সরি স্যার, ভেতরে আসুন।
পলাশ আর কোন কথা না বাড়িয়ে কেয়ার পিছন অনুসরণ করলো।
কেয়ার মুখটা বেশ গোলগাল। আঁখি দুটো কালো কালো। ঠোঁট দুটো কমলার কোয়ার মত। লম্বা লম্বা কেশগুচ্ছ কমড় ছুঁই ছুঁই। আপেলের মত গায়ের রং। ছিপ ছিপে কোমড়। দোহরা তার গড়ন। সুঢোল বাহুদ্বয়, অপরূপ শোভিত পদতল। সবকিছু মিলিয়ে এক অচিন্তনীয় সৌন্দর্য্যরে অবতারণা করছে তার মধ্যে।
রায়হান চৌধুরীকে দেখে পলাশ সালাম দিলো, আস্ সালামু আলাইকুম।
রায়হান চৌধুরী পত্রিকা থেকে চোখ নামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলেন, ওআলাইকুমুস সালাম। তারপর বললেন, তাহলে তুমি ঠিক তারিখেই এসেছ?
পলাশ মাথা নিঁচু করে করে বললো, জ্বি আঙ্কেল।
রায়হান চৌধুরী পলাশকে হাতে ইশারা করে সোফার সেট দেখিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।
পলাশ বসতেই তিনি আবার বললেন, কি যেন তোমার নাম বলছিলে?
পলাশ।
রায়হান চৌধুরী তারপর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে ডাকলেন। তারা আসতেই বললেন, দেখতো কে আসছে? তারপর পলাশকে দেখিয়ে বললেন, এ হচ্ছে তোমাদের মাষ্টার।
পরে তার পরিবারের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কেয়াকে দেখিয়ে বললেন, এ হচ্ছে কেয়া এবার এস.এস.সি পরীক্ষা পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে।
পলাশ বললো, তাই নাকি! আমিওতো ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি।
রায়হান চৌধুরী বললেন, তাহলেতো বেশ ভালোই হলো দু’জনে এক সাথে কলেজে যাবে। কি বল তুমি?
পলাশ মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসল। জ্বি আংকেল।
এ ফাঁকে কেয়া চলে গেল। তারপর চৌধুরী সাহেব শিখনকে দেখিয়ে বললেন আর এ হচ্ছে শিখন। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ওকে এ বছর বৃত্তি দেওয়াবো। তোমার সহযোগিতা পেলে সে ভাল রেজাল্ট করতে পারবে। ওর জন্যই তোমাকে রাখছি।
এ ফাঁকে কেয়া এক কেটলি চা ও বিস্কুট দিয়ে গেল।
রায়হার চৌধুরী এতক্ষণে চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর এক কাপ চা পলাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও চা পান কর। তারপর কেয়াকে বললেন, কেয়া তার রুমটা পরিষ্কার করে দেতো।
পলাশ চা-বিস্কুট খাচ্ছে আর কেয়া তার রুমটা সাজাচ্ছে। চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ হলো। তারপর রায়হান চৌধুরী তাকে তার রুমে নিয়ে আসলেন। পলাশ রুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেল, একটা টেবিল তার দু’পাশে দু’টো চেয়ার। টেবিলের পাশের বুক সেলফ। তাতে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের বই। একটা খাট এতে তোষক বিছানো। তোষকের উপর বেডসিট। তাতে দু’টো বালিশ ছিম ছাম পরিবেশ। ওর কাছে খুব সুন্দর লাগছে। এমন একটা পরিবেশই সে খুঁজছিল।
পলাশকে রুমে রেখে রায়হান চৌধুরী ও কেয়া দু’ জনেই চলে গেল।
রায়হান চৌধুরী এমনি দেখতে খুব ভালো মানুষ। কিন্তু তিনি এক কথার মানুষ। কখনো ওয়াদার বরখেলাফ করেন না। যা তিনি সিদ্ধান্ত নিবেন তা দুনিয়ার কেউ পাল্টাতে পারবে না। কথায় বলে, ‘হাকিম নড়েতো হুকুম নড়ে না।’ আর স্ত্রী সালেহা চৌধুরী তাঁর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ। স্বামীর কথার সাথে কোন কথাই মিলে না। কাজে কর্মেও মিলে না। তবুও তাঁর সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নম্র স্বভাবের এই আদর্শ রমণীটি সহজে অন্যের দু:খ বুঝতে পারেন। অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হন। মাঝে মাঝে তিনি খোদার কাছে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার মত অন্য নারীদেরকে এমন স্বামী দিও না।’ তিনি একজন পাকা গৃহিনী। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনিই করেন। কোন কাজের বুয়া নেই। খুব ভালো রান্না করতে পারেন। এমন কোন লোক নেই যে, তার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করেনি। সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন গুণবতী স্ত্রী সবার ভাগ্যে জুটে না। তাইতো মাঝে মাঝে রায়হান চৌধুরী নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করেন।
রায়হান চৌধুরী বিশিষ্ট শিল্পপতি। তিনি কেয়ার নামে ধানমণ্ডী এক ইন্ডাষ্ট্রিজ দিয়েছেন। তার নাম কেয়া গ্রুপ অফ ইন্ড্রাষ্ট্রিজ।
[উপন্যাসটির শুধুমাত্র ১ম পর্বটি প্রকাশ করা হয়েছে।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন