বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

গ্রন্থ পর্যালোচনা: ‘কৃষ্ণকলি’



 “আমি কালো মেয়ে। তাই আমাকে দেখে কোনো পুরুষের মনে যদি প্রেম না জাগে তাতে সেই পুরুষকে যেমন দোষ দেওয়া যায় না তেমনি আমাকেওতো দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু পরিবার, পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজন আমাকেই দোষতে লাগল। নানা কথায় আমার জীবনটা অতিষ্ট করে তুলতে লাগল। আবার অন্যদিক দিয়ে দেখো, কোন পুরুষের মনে প্রেম জাগানোর মতো কোনোকিছুই আমার চেহারায় না থাকলেও বয়স হওয়ার সাথে সাথে একজন সুন্দরী রাজকুমারীর মনে যেমন প্রেম জাগে আমারও তেমনি জেগেছিল। এক সময় আমারও বয়স ষোল বছর হয়। আমিও একসময় ষোড়শী হলাম এবং আমারও মনে তীব্র ইচ্ছা জাগল কারো প্রেয়সী হয়ে তার বুকে হুটোপুটি করতে; ভালোবাসার নীড়ে ভালোবাসি করতে। কিন্তু কেউ তো এলো না আমাকে ভালোবাসতে। ”
প্রকাশক প্রকৌশলী শামিম রহমান আবির কর্তৃক কুঁড়েঘর প্রকাশনী লিমিটেড থেকে একুশে বইমেলা-২০১৬ তে প্রকাশিত হয় তরুণ গল্পকার হামিদ আহসানের দ্বিতীয় গল্পের বই ‘কৃষ্ণকলি’। ৭২ পৃষ্ঠার গল্পগ্রন্থটি চার রঙা প্রচ্ছদে ছাপানো হয়েছে। বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন প্রচ্ছদ শিল্পী চারু পিন্টু। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বইটিতে মোট ঊনিশটি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পে আছে নতুন নতুন ভিন্নতা। চমৎকার সব গল্প দিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইটি সাজানো হয়েছে। গল্পগুলো ভাষা সহজ-সরল, সহজেই পাঠককে টেনে ধরবে। এক মলাটের ভেতর এতগুলো সুন্দর গল্প একসাথে পাওয়া পাঠকের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার।



‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। 
মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে, কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটো, মুক্তবেণী পিঠের‘পরে লোটে। 
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই লাইনগুলো দিয়ে হামিদ আহসান তাঁর ‘কৃষ্ণকলি’ গ্রল্প-গ্রন্থটি শুরু করেন। বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর আদরের দুই কন্যা ফারিহা তাবাসসুম স্বর্ণা এবং তাসফিয়া তামান্না বিভাকে।



‘কৃষ্ণকলি’ গল্পে তিনি একজন কালো মেয়ে জীবন আলেখ্য বর্ণনা করেছেন। কালো হয়ে জন্ম নেয়া কোন পুরুষের মনে তার প্রতি প্রেম জাগে না বরং ঘৃণা জন্মায়। গল্পের নায়িকা আফসানা নিশি। নিশি মানে রজনী। রজনী মানে রাত। রাত মানে কালো। কালো মানে কৃষ্ণ। তার ধারণা গায়ের রঙ কালো হওয়ায় বাবা-মা তার নাম রেখেছে নিশি! এই জন্য বন্ধুদের সবাইকে সে বলে তারা যেন তাকে কৃষ্ণকলি নামেই ডাকে। 



কালো মেয়ের প্রতি কোনো পুরুষের ভালোবাসা না থাকলেও তার যে একটা মন আছে সেটাতো কালো নয়। একজন সুন্দরী মেয়ের মনে যেমন প্রেম জাগে তার মনেও তেমন প্রেম জাগে। তারও স্বাদ জাগে কারো প্রেয়সী হয়ে ভালোবাসার নীড় গড়ে তুলতে। কালো হওয়ায় তার প্রতি ভালোবাসা না জন্মালে ঘৃণা কেন জন্মাবে? এভাবেই ‘কৃষ্ণকলি’ গল্পটি হামিদ আহসান তাঁর মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েছেন। 



‘কৃষ্ণকলি’ গল্প-গ্রন্থে তিনি একে লিপিবদ্ধ করেন- বেওয়ারিশ, আমিও ছিলাম, যাপিত বিভ্রম, মায়ের মন, দয়াময়ী আশ্রম, গাঙেয় ব-দ্বীপ বঙ্গাব্দ ১৪৫২, অবশেষে সুরত বানু নিজের ঠিকানায়, অদ্ভুদ গো-ধূলিতে, এভাবেই হয়, কয়েকজন মুখোশধারী, খেলাঘর, খন্দকার আবদুল মজিদের রহস্যময় কিছু রাত, প্রেমের পারাপার, দুঃস্বপ্নের দশই নভেম্বর, ক্রেজিদের শহের একটি বাস-ভ্রমণের গল্প, আফসোস, ভেবেছিলুম গাঁথব মালা- পাইনে খুঁজে ডোর, পাপ।



‘কৃষ্ণকলি’ বইয়ের যেসব গল্পগুলো পাঠকের মনে দাগ কাটবে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘বেওয়ারিশ’। যেখানে গল্পকার বেওয়ারিশ একটি লাশের দাফন নিয়ে যে জটিলতা দেখা দেয় তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। 



‘মায়ের মন’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন একজন শিক্ষিত ছেলে কিভাবে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আরাম আয়েশে জীবন যাপন করেন। অন্যদিকে মা এত কষ্টের পরও ছেলের কুর্কীতি কারও কাছে প্রকাশ করেননি। ছেলের বিরুদ্ধে কখনো কারো কাছে অভিযোগও করেননি। এমনকি তিনি মন খারাপ করতেও চান নি, পাছে তার সন্তানের কোনো অমঙ্গল হয়! মায়ের মন বুঝি এমনই হয়! 



‘অবশেষে সুরত বানু নিজের ঠিকানায়’ গল্পে গল্পকার এখানে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক অসহায় ভিক্ষুক সুরত বানুর কথা সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। একসময় সুরত বানুর সবই ছিল। ঢাকার একদম কাছেই ছিল তাদের গ্রাম। এই ঢাকার একদম কাছে থাকাটা যেন কাল হয়েছে তাদের জন্য। ঢাকা গ্রাস করে নেয় তাদের গ্রামটি। এক সময় সুরত বানুসহ তাদের এলাকার সবাইকে উচ্ছেদ করে এখানে গড়ে তোলা হয় আবাসিক শহর। তাদের সেই চির চেনা নিতান্ত গ্রামটি অভিজাত ঢাকার একটি অংশ হয়ে গেছে। সুরত বানুদের মতো ভিক্ষুকরা সেখানে এখন প্রবেশাধিকারও পায় না। তারপর তার ঠিকানা হয় ঢাকার একটি বস্তিতে। যেখানে থেকে তিনি ভিক্ষা করতেন। একমাত্র নাতনীকে নিয়ে তিনি জীবন ধারণ করছেন। সেই অভিজাত এলাকায় তৈরি হয় বৃদ্ধাশ্রম। অবশেষে একদিন সুরত বানুর আশ্রয় সেই বৃদ্ধাশ্রমে হয়। যেখানে একদিন তাদের ঘর ছিল, সংসার ছিল।



‘ক্রেজিদের শহরে একটি বাস-ভ্রমণের গল্পে’ গল্পকার বাসভ্রমনের একটি মজার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। পাবলিক বাসগুলোতে যাতায়ত করতে নিত্যদিন যেসব ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হতে হয় তার একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া গেছে এই গল্পে। একদিন গল্পকার আজিমপুর থেকে কাকলী যাওয়ার জন্য রওয়ানা হন। এই অল্প সময়ে বাসের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। সর্বশেষ খালি আসনটায় গল্পকার সিট পেলেও অনেক লোকজন সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকজন হুড়মুড় করে বাসে উঠছেন। একেবারে ঠেসে ভরে গেল বাসটা। বাসটি স্টপেজ ছাড়তেই কিছুক্ষণ পরই গল্পকার লক্ষ্য করলেন এক ভদ্রলোক ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরা; পায়ে কালো সু। দেখেই মনে হচ্ছে অফিসে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “ভাই যারা গেটে আছেন পকেট, মোবাইল সাবধান। এই স্টপেজ ভালো না প্রায়ই পকেটমার হয়। মোবাইল টোবাইল নিয়ে নেয়”। এই কথা বলার সাথে সাথে একজন চিল্লাইয়া উঠল, “ভাই আমার মোবাইল নিয়ে গেছে।” সবাই যখন চোর খুঁজতে লাগল তখন গল্পকারের মাথায় আসল যিনি সাবধান হতে বললেন তিনিই চুরি করতে পারেন। তার পকেট চেক করা হউক। অবশেষে গল্পকার যাহা সন্দেহ করেছিলেন তাই হল। এর কিছুক্ষণ পরই এই বাসটি এক অটোরিকশাকে ধাক্কা মারে। বলা যায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন অটোরিকশার যাত্রীরা। এর জের হিসেবে ড্রাইভারের উপর শুরু হয় গণপিটুনি।
এভাবেই বাকিগল্পগুলো ভিন্ন স্বাদে সবলিল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে ‘কৃষ্ণকলি’ গল্প-গ্রন্থে।



লেখক সর্ম্পকে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় হামিদ আহমান একজন প্রতিভাবান লেখক। যিনি চমৎকার সব গল্প লিখেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পুরনো ঢাকার লালবাগে জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই বেড়ে উঠা এবং এখনও তিনি এখানেই বসবাস করছেন। তিনি পেশায় একজন ব্যাংকার। বর্তমানে একটি বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত আছেন। ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী শামিমা আক্তার বৃষ্টি এবং দুই কন্যা ফারিহা তাবাসসুম স্বর্ণা এবং তাসফিয়া তামান্না বিভাকে নিয়ে তার সংসার 



কৈশোরেই এক শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ের দেয়ালিকা দিয়ে গল্প লেখা শুরু। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন সাহিত্যপত্র সহ প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক নানা প্রকাশনায় নিয়মিত লেখালেখি করে আসছেন। বিভিন্ন ব্লগেও নিয়মিত লিখছেন। তার প্রকাশিত প্রথম গল্প-গ্রন্থ ‘মরীচিকার টানে’ প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে। কৃষ্ণকলি তাঁর দ্বিতীয় গল্প-গ্রন্থ। গল্প ছাড়াও নিজের পেশাগত বিষয়ের ওপর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন দৈনিকে লেখালেখি করেন।



পরিশেষে বলবো, কৃষ্ণকলি; গল্প-গ্রন্থে বেশ কয়েকটি গল্প পাঠককে হতাশা করলেও বেশিরভাগ গল্পই পাঠক ধরে রাখার মতো। সর্বপরি আমি বলব হামিদ আহসান বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। পাঠক তার কাছ থেকে আরো ভালো গল্প চায়। আশা করি পাঠকের সেই আশা পূরণে তিনি নিয়মিত লিখবেন। 

কোন মন্তব্য নেই: