বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০১৫

প্রতিটি দিন হোক ভালোবাসা দিবস



ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ আর আকাঙ্খিত একটি আবেদন। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। ভালোবাসা শব্দটি খুব সহজেই সকলের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে মিশে যায়। কেননা জন্মের পর থেকেই মানুষের বেড়ে উঠা এই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই। ভালোবাসা না থাকলে কোন পরিবার থাকত না। ভালোবাসা নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সর্বত্রই
পাওয়া যায় ভালোবাসার সন্ধান। ঠিক কবে এই ভালবাসার উপত্তি হয়েছে তা জানা সম্ভব না হলেও এতটুকু জানতে ‍পারি যে, এর ইতিহাস বিবর্তনের চেয়েও আদিম ও পুরোনো। প্রাণীজগতের অন্যান্য সব প্রাণের মাঝে ভালোবাসা পরিলক্ষিত হলেও মানুষ যেভাবে একে জীবন ও প্রেরণার অনুষঙ্গ করেছে তা আর কেউ পারেনি। ভালোবাসা নামের এই অজানা অদেখা আর চাপা কষ্টের সেই অব্যাক্ত অনুভুতিকে মহিমান্বিত করতেই নাকি প্রতি বছরের একটি বিশেষ দিনকে ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। যা ইংরেজীতে বলা হয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে। পাশ্চাত্যের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনটি ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ভালোবাসা দিবস শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে কপোত কপোতিদের হাত ধরে ঘোরা ফেরা করা। লাল শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে প্রেমিকের সাথে যাওয়া। ফুল, চকলেট, কার্ড উপহার দেয়া। কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছে ভালোবাসা দিবস? কেনোই বা তা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়? আমরা একটু খোঁজ নিলেই দেখব এরও এক পুরোনো ইতিহাস আছে? কেন এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে? আর কবে থেকেই এই দিবসের শুরু? কে ছিলেন ভ্যালেন্টাইন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের কয়েক শতাব্দী পেছনে হাঁটতে হবে।
ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন'স ডে একটি বার্ষিক উসবের দিন যা ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রেম এবং অনুরাগের মধ্যে উদযাপিত করা হয়। এই দিনে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড, গহনা প্রভৃতি উপহার প্রদান করে দিনটি উদ্‌যাপন করে থাকে। এর ইতিহাস সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানি। ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন'স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার-অভিযোগে তকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে চিকিসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন'স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন' দিবস ঘোষণা করেন।
পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের সব, ধর্মোসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উসব নিষিদ্ধ হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন উসব পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা থেকে বিরত থাকার জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়
উনবিংশ শতাব্দীতে এই দিনটি সার্বজনীন উসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরু হয় ভালোবাসার মানুষকে ফুল, কার্ড, চকলেট, অলংকারসহ নানা উপহার দেয়া। চালু হয় একান্তে সময় কাটানোর রীতি। বিংশ শতাব্দীতে ভালোবাসা দিবস পৌঁছে যায় মানুষের হৃদয়ে গভীরে। ভালোবাসা দিবস ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে নানা বৈচিত্র লক্ষণীয়। ফিনল্যান্ডে এর নামইস্তাভানপাইভাযার অর্থ বন্ধুত্বের দিন। চীনে ভালবাসা দিবসকে বলা হয় কিক্সি ফেস্টিভালযা উদযাপিত হয় চন্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে। ল্যাটিন আমেরিকাতেও এই দিবস উদযাপিত হয় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার দিন হিসেবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল, গ্রীস, স্পেন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নামে দিনটি উদযাপিত হয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ সব দেশেই বাড়ছে এ দিনটির কদর। বিশেষ করে তরুণ সমাজে মাঝে এ দিনটির কদর বেশী।
১৪ ফেব্রুয়ারি মানেই তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি কাঙ্ক্ষিত দিন। দুনিয়াজুড়ে এ দিনটিকে অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে। তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও দিনটি নিয়ে থাকে প্রচুর মাতামাতি। হঠা করেই যেন আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলনটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। গত এক যুগ ধরে ভালোবাসা দিবসে উপহার ও ফুলের দোকানগুলোর ব্যবসা থাকে রমরমা। ১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের শুরুটি করেন। এ নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শফিক রেহমানের চিন্তাটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। সেই থেকে প্রতি বছর আমাদের দেশেও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এই দিবসটি পালন করা হয়।
কিন্তু এই ভালোবাসা দিবসের নামে মুসলমানরা আজ শুধু অধঃপতনের দিকেই যাচ্ছে। নিজের শালীন সংস্কৃতি ভুলে আধুনিকতার নামে দেশীয় সংস্কৃতি ভুলে বেছে নিচ্ছে ভিনদেশী অপসংস্কৃতি। ভালোবাসা দিবসও এর বহির্ভুত নয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, যাকে কেন্দ্র করে করা হয় হাজারো বেহায়া ও বেলেল্পাপনাময় কর্মকান্ড পার্ক জুড়ে দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার ঢল। ফুল দিয়ে মন বেচা-কেনাসহ কত যে অযাচিত ঘটনা। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরাই সাধারণতঃ এতে অগ্রগামী। তারা সহজেই হারিয়ে যায় নিজেদের ভবিষ্যত সম্ভাবনা ভুলে যৌবনের মৌ-বনে। এ দিনে হোটেল গুলোতে চলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের রাত্রী যাপন। ডিজে পার্টির নামে চলে অশ্লীল কর্মকান্ড।
ভালোবাসা চিরন্তণ এবং সব মানুষের মধ্যেই এটি সবসময় বিরাজ করে। অতীতে ভালোবাসা ছিলো নিতান্তই আত্নিক, তাই প্রকাশ ছিলো শুধু ভালোবাসার মানুষগুলোর মধ্যে, লোক দেখানো ব্যাপারটি অনেকে চিন্তাও করতো না। এখন হয় এর উল্টোটি। এখন ভালোবাসা অনেকাংশেই লোক দেখানো ব্যাপারটি জড়িত থাকে। এজন্য এইসব ভালোবাসা দিবসের উত্থান। আর এই দিনটিতে রাজত্ব করবে ভন্ড প্রেমিক-প্রেমিকারাই। সরল ভালোবাসা বুকে ধারণ করা মানুষেরা শুধু দর্শক আজকের দিনের জন্য।
তাই আমি পরিশেষে বলব, আজকের ভালোবাসার দিবস যেন শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য না হয়। এই দিবস যেন একদিনের জন্য না হয়। ভালোবাসা দিবস সকলের জন্য। এখানে মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা থাকবে। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা থাকবে। ভাই-বোনের ভালোবাসা থাকবে। এই ভালোবাসা প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করবে সারা বছর। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের ভালোবাসায় রাঙিয়ে গেলেও, ভালোবাসা কিন্তু প্রতিদিনের। জীবনের গতি নির্ধারণ করে ভালোবাসা। মানুষ বেঁচে থাকে ভালোবাসায়। ভালোবাসাকে শুধু মাত্র একটা দিন দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না। আমার মতো হয়তো অনেকেই সুর মিলিয়ে বলবেন, ভালবাসা দিবসের কি প্রয়োজন? প্রতিটি দিন হোক ভালোবাসা দিবস। নির্দিষ্ট কোনো দিনে ঘটা করে একে পালন করার কোনো মানে হয় না। এটা নিছক পাগলামো বৈ আর কিছুই নয়।

সূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্র
রচনাকাল: ১০/০২/২০১৪খ্রি:
নক্ষত্রব্লগ কর্তৃক সৃজনশীল ব্লগিং প্রতিযোগিতা-২০১৫ এর পুরস্কার প্রাপ্ত



কোন মন্তব্য নেই: