বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে একাধিক প্রাণ

মানুষ মরণশীল। একদিন সবাইকে মরতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু অনাকাংক্ষিত বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মরতে হবে তা তো মেনে নেয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু যেন এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ও রাজধানীর বাইরে মহাসড়কগুলোতে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এ দুর্ঘটনা কি রোধ
করার কোন উপায় নেই? আমাদের দেশে প্রতিমাসে সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কেন এই দুর্ঘটনা ঘটছে? এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? বা কারা তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা এখনই প্রয়োজন। তা না হলে দেশে আরো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটবে।
প্রতিদিন যে সড়ক দুর্ঘটনায় কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তার কোন নির্ভরযোগ্য হিসেব কেউ দিতে পারে না। সব দুর্ঘটনা সাংবাদিকদের নজরে পড়ে না। আর নজরে পড়লেও সব দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় আসে না বা রেডিও টেলিভিশনে প্রচার হয় না। এই জন্য সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। তবে গত এপ্রিল, মে দুই মাসের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ৬ এপ্রিল ভিকারুননিসা নুন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী তানজিলা সারা পরীবাগে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর গত ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের আনন্দঘন দিনে সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেছে। ২২ এপ্রিল টাঙ্গাইলের দুটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত হয়। মাত্র ১১ ঘন্টার ব্যবধানে দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। হতভাগ্য বাস যাত্রীরা সবাই গাইবান্দা ও কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিল। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের ৬ জন ব্যক্তি রয়েছে। ২৩ এপ্রিল ঢাকার মালিবাগে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাস চাপায় নিহত হয় ৯ বছরের স্কুল ছাত্র মানিক চাঁদ। ওই দিনই ঢাকা মহানগরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ জনের মৃত্যু হয়। ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার মিরপুরে জনবহুল সড়কে বাসচাপা পড়ে ১২ বছরের স্কুল ছাত্র অমির মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। বাসস্ট্যন্ডে দাঁড়িয়ে অমি বাসে উঠার জন্য অপেক্ষা করার সময় দুটি যাত্রীবাহী মিনিবাস পরস্পরকে টেক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বেপরোয়া প্রতিযোগিতার শিকার হয় অমি। সাথে সাথে ঝরে গেল হাসি-খুশী টগবগে কিশোরের জীবন প্রদীপ। ২৬ এপ্রিল দুপুরের পর যমুনা সেতুর সংযোগ সড়কে কারিহাতি উপজেলার পোলি ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে গাইবান্ধা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাস নদীতে পড়ে ২২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। একই দিনে ভোরে গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি ট্রাকের সঙ্গে আরেকটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক ও হেলপারসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়। ২ মে বরিশাল, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, আড়াইহাজার, চিতলমারী,শাহজাদপুর, ফেনিতে পৃথক ৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে গেল ১৬টি প্রাণ। ১৪ মে বগুড়ায় ট্রাক চাপায় বগুড়া জেলা স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র তানভির হাসান রাকিব নিহত হয়। সকাল ১০ টায় রাকিব নুরানী মোড়ে রিক্সা নিয়ে পৌছলে দ্রুতগ্রামী একটি ট্রাকের ধাক্কায় রিক্সা থেকে সে ছিটকে পড়ে ট্রাকের নিচে চলে যায়। আর সাথে সাথে তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। ১৭ মে ঢাকা- নরসিংদী সড়কের চৌয়ালায় যাত্রীবাহী বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে স্কুল ছাত্র সাব্বিরের করুণ মৃত্যু ঘটে। ১৯ মে নরসিংদী শীলমান্দীতে সকাল সাড়ে ১০ টায় যাত্রীবাহী বাস ও চাউল ভর্তি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’চালকসহ ৫ জন নিহত হয়। ২৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী শাম্মী আক্তার হ্যাপী গুলিস্তান-আব্দুল্লাহপুর রুটে একটি মিনিবাসের তলে চাপা পড়ে নিহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে ছুটে আসে বাসটি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকার নিচে চলে যায় শাম্মী। তার সাথে সাথে একটি মেধাবী ছাত্রীর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। ঐদিনই মুন্সিগঞ্জ ও রংপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১৩ জন। ৩০ মে লক্ষীপুর ও শেরপুরে পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৪ জন। সর্বশেষ গত ১৪ জুন মঙ্গলবার কুমিল্লায় চৌদ্দগ্রামে একই পরিবারে ৫ জনসহ ৭ জন নিহত হয়। তাছাড়া গত পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও পাশের সড়কে বেশ কিছু সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০০১ সালে ৩০ অক্টোবর পলাশি মোড়ে বাস চাপায় এক ছাত্রী নিহত হয়। ১৯৯৮ সালে কাঁটাবন মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ ৪ জনের মৃত্যু ঘটে।
এভাবে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। কিন্তু সরকার এই অনাকাংক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যানবাহন চলাচলে নেই কোন শৃঙ্খলা। যানবাহনগুলোর যেন একে অপরকে টেক্কা দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। রাজধানী ঢাকাতে নেই রাস্তা পারাপারের কোন নিয়ম। হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় আন্ডারপাস ও ওভারব্রিজ আছে। শতশত যানবাহন বিরতিহীনভাবে চলে। পথচারীরা রাস্তা পারাপারের কোন সুযোগ পায় না। তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। আর তখন ঘটে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। কর্তৃপক্ষ এসব দেখে না। তারা রঙিন চশমা চোখে দিয়ে এসব করুণ মৃত্যুর দৃশ্য দেখছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ একাধিক। এর মধ্যে প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো। প্রশিক্ষণবিহীন ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো। মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো। হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো। ওভারটেক করা। বাসের ছাদের যাত্রী ও মাল বহন করা। ত্রুটিপূর্ণ রাস্তার কারণে। পথচারীদের অসতর্কতা। ট্রাফিক আইন না মানা। অনেক সময় চালকরা প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালায়। তারা পথচারীর প্রতি ভ্রুপক্ষেপও করে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় গাড়ীতে যাত্রী উঠানো নামানোর গাফিলতির জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে। আবার কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। পথসভা, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদির কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। যার জন্য দুর্ঘটনা সৃষ্টি হয়। হকারদের ফুটপাত দখলের ফলে পথচারীরা রাস্তায় নেমে চলাচল করে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
অকালে এবং অনাকাক্সিক্ষকতভাবে আর যেন কোন মানুষের মূল্যবান জীবন ঝরে না যায় সেজন্য সরকারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক দ্বারা যানবাহন চালানো নিশ্চিত করতে হবে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে জনসংখ্যাও। তাই এখনই প্রয়োজন প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যানবাহন চালানোর প্রতিযোগিতা। হকারদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, ত্রুটিমুক্ত বড় সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। যানবাহনের ফিটনেস পথচারীদের নিরাপদে পারাপার ও রাস্তা চলাচলের সুব্যবস্থাক করতে হবে। ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি প্রয়োগ করতে হবে। জেব্রা ক্রসিং এর উপর দিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হতে হবে। বড় বড় শহরগুলোতে ওভারব্রীজ তৈরি করতে হবে। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী- এই বক্তব্য শুধু শ্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

প্রকাশকাল: বুধবার, ১৫ জুন ২০০৫ইং

কোন মন্তব্য নেই: