প্রকৃতির দুই রূপ- সৃষ্টি ও ধ্বংস। প্রকৃতি একদিকে গঠন করছে, অন্যদিকে বিনাশ করছে। বিভিন্ন কারণে প্রকৃতি ধবংস হয়। যেমন- ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, খড়া, বন্যা ইত্যাদি। তবে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যার আঘাতই সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত: কিছু কিছু এলাকায় আঘাত এনে ক্ষতি করে থাকে এবং এর স্থায়ীত্বকাল অল্প সময়। কিন্তু বন্যা প্রায় সমগ্র দেশে আঘাত এনে প্লাবিত করে থাকে। এর স্থায়ীত্ব বেশিদিন থাকে। তখন অসহায় হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বন্যার ভয়াবহ দৃশ্যের উৎস, জনজীবনে দু:খ, কষ্ট নেমে আসে। বন্যা যেন এখন নিয়মিত বার্ষিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে।
আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ। কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। আজ জনবহুল ও দরিদ্র বাংলাদেশের উন্নয়নের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যা। বন্যার কারণে প্রায় প্রতি বছর উন্নয়ন কর্মকান্ডের একটা বিরাট অংশ বাইরে চলে যায়। বন্যাকালীন দুর্দশার চিত্র অবর্ণনীয়। সামগ্রিক জীবনযাত্রা মারাত্মক রূপে ব্যাহত হয়। সারা দেশে ধ্বংসের চিহ্ন দেখা যায়। আপনজনদের হারানোর হাহাকার গভীর দাগ কাটে। প্রকৃতির এই খেয়ালীপনার কাছে মানুষ আজ অসহায়। বন্যার সর্বনাশী টানে ঘর-বাড়ি ভেসে যায়। কৃষকের স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। শস্যের ক্ষতি হয় ব্যাপক। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বিমানবন্দর, স্থলপথ, রেলপথ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। যে মহাসড়কে গাড়ী চলে সেখানে চালাতে হয় নৌকা। ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘিœত হয়। গবাদি পশুর মৃত্যু হয় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন মানুষের একমাত্র আশ্রয় হয় ঘরের চালে বা গাছের ডালে। বন্যা পরবর্তী দৃশ্যও করুণ। নানা প্রকার ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়। পেটের পীড়া, আমাশা, সর্দি, জ্বর, কাশি ইত্যাদি হয়।
বন্যাকে আমরা সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
(১) সাধারণ বন্যা
(২) তীব্র বন্যা
(৩) মারাত্মক বন্যা
(৪) প্রলয়ংকরী বন্যা
এক হিসাবানুযায়ী দেখা গেছে প্রতি ১০ বছর অন্তর অন্তর প্রলয়ংকরী বন্যা দেখা দেয়। গত ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালে এদেশে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়ে গেছে। এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যাকে হার মানিয়ে একধাপ উপরে চলে গেছে। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায় পেছনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই এদেশে গত ১০০ বছরে ১৯১০, ৩১, ৫৪, ৫৬, ৬২, ৬৬, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০, ৮৪, ৮৭, ৮৮, ৯৮, ২০০০ ও বর্তমান ২০০৪ সহ ১৭ বার বন্যা হয়েছে। গড়ে প্রায় পাঁচ বছর অন্তর অন্তর একবার বন্যা হয়েছে। তাছাড়া ছোট খাট বন্যা প্রতি বছরই হচ্ছে। এভাবে যদি বন্যা হয় তাহলে আমাদের দেশ কিভাবে উন্নত হবে?
এ বছর হঠাৎ করেই যেন বন্যার আলামত দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় ৬৪টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তবে বন্যার প্রকোপ সবচাইতে বেশি দেখা দিয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে। জেলাগুলো হচ্ছেÑ সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, কুমিল্লা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার প্রভৃতি। প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী যদি এভাবে বাংলাদেশে বন্যা হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থা কি হবে? তাকে কি নিয়ন্ত্রণ করার কোন নেই? এবার বাংলাদেশে বন্যার হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
(১) অতিবর্ষণ: আমরা বন্যার কারণ হিসেবে অতিবর্ষণকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টি বহুল এলাকা চেরাপুঞ্জি মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। তাই এ অঞ্চলে অধিক বৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা দেখা দেয়।
(২) ভৌগলিক অবস্থান: ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বন্যা দেখা দেয়। এদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এ প্রধান তিনটি নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬-৭ মিটার উঁচু। ফলে বর্ষকালে যখন তিনটি নদীর বিশাল অববাহিকায় পানি এক সঙ্গে এসে পড়ে তখন বাংলাদেশে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে তা থেকে বন্যার সৃষ্টি হয়।
(৩) নিম্নাঞ্চল ভরাট: দেশের প্রায় নিম্নাঞ্চল ভরাটের ফলে নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে তা থেকে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়।
(৪) হিমালয়ের বরফগলা পানি: পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বতমালা হিমালয় আমাদের দেশে অবস্থিত। গ্রীষ্মকালে তাপে বরফ গলে কোটি কোটি কিউসেট পানি গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়।
(৫) অরণ্য নিধন: গাছপালা কেটে অরণ্য নিধন করা হচ্ছে। গাছপালার শিকড়ে বাধা পেয়ে অনেক বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে চলে যায়। কিন্তু গাছপালাও বনাঞ্চল উজাড় করার ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পানি সরাসরি নদীতে চলে যায়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
(৬) ফারাক্কা বাধ: ভারত প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে ফারাক্কার পানি আটকে রাখে এবং বর্ষা মৌসুমে সকল গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়ার সন্ত্রাসী প্রয়াস চালায়। যার ফলে বাংলাদেশের বন্যার আকার ভয়াবহ ধারণ করে।
বন্যার প্রতিকার কিভাবে করা যাবে তা নিয়ে হয়তো আমরা অনেকে চিন্তা করি না। আমরা বন্যা সমস্যার প্রতিকার গুলো জেনে নিই।
(১) বন্যা সর্ম্পকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২) ত্রাণ সামগ্রী মজবুত রাখতে হবে।
(৩) প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বহুতল আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
(৪) উজান এলাকায় জলাধার নির্মাণ করে বর্ষাকালে নদীর উদ্বৃত্ত পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(৫) নদীর উপচানো পানি প্রতিরোধে সারাদেশে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
(৬) পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিস্তুৃত করে দিতে হবে।
(৭) রাস্তাঘাটের মাঝে মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ কালভার্টসহ পানি সরবরাহ পথের সৃষ্টি করতে হবে।
(৮) ভরাট নদী-নালা সংস্কারের মাধ্যমে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
(৯) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
(১০) আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা গ্রহণের মাধ্যমে বৃহৎ নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
বন্যা সমস্যার প্রতিকারেরই উপরই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বন্যার স্থায়ী সমাধানের ওপর নির্ভর করছে দেশের মানুষের স্বস্থি ও শান্তি। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের অসহনশীল মনোভাবকে রাজনৈতিবভাবে মোকাবেলা করে মরণ ফাঁদ ফারাক্কাকে রুখতে হবে। সে জন্য চাই জাতীয় উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও।
প্রকাশকাল: বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৪ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন