মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৪

ঐতিহাসিক মে দিবস ইতিহাসের এক করুণ ট্রাজেডী

১ মে একটি ঐতিহাসিক দিন। একটি দিক নির্দশক ও পথ প্রদর্শক ও পৃথিবীর মেহনতী মানুষের প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। মালিকের শোষণ, পীড়ন, অত্যাচার, অবিচার থেকে মুক্তির দিন। শ্রমিকের লড়াই, সংহতি, দৃঢ়তা ও রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা অর্জিত বিজয়ের দিন। এদিনে শ্রমিকরা রক্তে রঞ্জিত লাল নিশানের তলে দাঁড়িয়ে আপোষহীন সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করে। তারা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ হন। মে দিবসের ঘটনাটি মূলত: ঘটিয়েছিল সাধারণ শ্রমিকরা। এ জন্যে মে দিবসকে শ্রমিক দিবস বলা হয়ে থাকে। যা বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস ব্যাপক। এর গোড়াপত্তন হয় ১৮৩০-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এখন সংক্ষেপে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হল।

১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথস শ্রমিক আন্দোলন আন্তর্জাতিকতা লাভ করে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এ একজন শ্রমিককে তার সহকর্মী শ্র্রমিকদের সমস্যা আলোচনার জন্যে সভা করার অপরাধে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হয়। ১৮৩৬ সালে এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন লন্ডনের ওয়াকিব মেনস এসোসিয়েশনের নেতা উইলিয়াম লোভেট। ১৯৪৭ সালের কাল মার্কস, এঙ্গেল প্রমুখ মনীষীরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন। যার বাক্য ছিল দুনিয়ার মজলুম এক হও।১৮৬০ সালে ইতালী, জার্মানী ও রাশিয়াতে কিছু কিছু রাজনৈতিক সংস্কারমূলক কর্মকান্ড শুরু হয়। তখন ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রমিকরাও সমাজের মধ্যে এর প্রতিফলন ঘটান। ১৯৬৪ সালে পশ্চিম ইউরোপের প্রধান দেশসমূহের শ্রমিক নেতারা লন্ডনের সেন্টমার্টিন হলে মিলিত হন। এটি তখন ফ্রান্স, জার্মানী, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইতালী, পোল্যান্ড, রাশিয়া ও আমেরিকা প্রভৃতি দেশে এ সংঘের বিস্তৃতি ঘটে। ১৮৭০ সালে প্যারিসে শ্রমিক শ্রেণীর বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। হাজার হাজার শ্রমিকের আত্মহুতির মধ্য দিয়ে মাত্র ৭২ দিনের ক্ষমতার মেয়াদ পরিসমাপ্তি ঘটে। অতপর ১৯৭৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেস (TUC) ও ১৮৮০ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার (AFL) এর শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটে। এত কিছুর পরও শ্রমিকরা ধনতান্ত্রিক পুঁজিপতির হাত থেকে রেহায় পায়নি। পুঁজিপতিরা শ্রমিকদেরকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। আর এদিকে শ্রমিকরা হতে থাকে নি:স্ব। তাই সুযোগ বঞ্চিত শোষিত শ্রমিকরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে দাবি আদায়ের জন্যে মিছিল ধর্মঘটে শামিল হতে বাধ্য হন। এই ধনতান্ত্রিক পুঁজিপতিরা শ্রমিকদেরকে দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৮/২০ ঘন্টা কাজ করিয়ে নিত। বিনিময়ে দিতনা কিছুই। পুঁজিপতিদের এই অমানুষিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৮৮৬ সালের ১ মে দিনটি ছিল শনিবার। আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। ২ মে রবিবার সরকারি ছুটির দিন শ্রমিক নেতা এলাবার্ট আর পার্মনম সিন্নামিন্নাটি গিয়ে বক্তৃতা করে। শ্রমিকদের এই ঐক্যবদ্ধতাকে শোষক শ্রেণী সুনজরে দেখতে পারেনি। তাই তারা ৩ মে ম্যককীমক রিপার কারখানার ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সমাবেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। উক্ত গুলিবর্ষণের ফলে নিহত হন আমেরিকার শিকাগো শহরের অগাস্ট, স্পাইম, পারসন্স, এন্সেল ও ফিশারন। আহত হন অনেক শ্রমিক। ৮ মে এ গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারেলাখো মানুষের এক বিরাট সমাবেশ হয়। এই সমাবেশেও বিস্ফোরিত হয় এক বোমা। নিহত হয় জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের উপর আক্রমণের অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের উপর শুরু করল বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। কিন্তু নির্যাতিত শ্রমিকরা পড়ে পড়ে মার খেয়ে এখন ভয়াল মূর্তি ধারণ করে। এ সংঘর্ষে ৪ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ নিহত হয়। সারা হে মার্কেট রক্তে লাল হয়ে গেল। সেই রক্তাক্ত ঘটনার পর থেকে শোষক শ্রেণীরা শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। কারাগারে প্রেরণ করল অনেক শ্রমিক। চললো বিচারের নামে প্রহসন।
১৮৮৬ সালে ২১ জুন শিকাগোতে বিচার কার্য শুরু হয়। আসামীরা হল আগস্ট, স্পাইজ, জর্জ এঞ্জেল, এডলফ ফিশার, মাইকেল স্কোয়ার, সাম দিল ডেন, লুই লিফগ ও অস্কার নীবে প্রমুখ। ১৮৮৬ সালে ৯ অক্টোবর বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। জনমতকে উপেক্ষা করে ৪ জন শ্রমিক নেতাকে ঐ রায়ে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। আর ৩ জনকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। এই বিচারকে অমান্য করে শ্রমিকরা আবার আন্দোলনে ফেটে পড়ে। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কিন্তু শোষকরা কিছুতেই তাদের প্রতিবাদে কান দেয়নি। অবশেষে তারা বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে ১৮৮৭ সালের ১২ নভেম্বর শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে। কিন্তু এত কিছু করার পরও শোষকরা শ্রমিক আন্দোলনের গতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতারা মিলিত হন। তারপর অনেক চড়াই উরাই পেরিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (ILO) গঠিত হয়। ১৮৮৯ সালে গৃহিত হয় হে মার্কেটের নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হবে। পরে ১৮৯০ সালে আমেরিকা ইউরোপের শ্রমিকরা গ্রেট বিটেনের হাইডপার্কে সমবেত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সভায় প্রথম বারের মত মে দিবস পালন করে। পরবর্তীতে এশিয়া, আফ্রিকা, চীন, জার্মানী ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে মে দিবসের সূচনা হয় ১৯২৩ সালে মাদ্রাজে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও মে দিবস পালন করা হয়। এভাবে সারা বিশ্বের মেহনতী শ্রমিক শ্রেণীর সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে মে দিবস প্রতি বছর জাঁকজমকভাবে পালন করে আসছে। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্যে রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি করার পর আজও এই নিরহ শ্রমিকরা শোষকদের হাত থেকে রেহায় পাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পরিশেষে বলবো, আজ থেকে ১১৮ বছর পূর্বের অর্থা ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটে যে রক্তের ফোয়ারার মাধ্যমে শ্রমিক দিবসের সূচনা হয়েছিল, সেই মহা শ্রমিক দিবসের শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মিলেমিশে থাকি তাহলে কেউ আর আমাদেরকে শোষণ করতে পারবে না।

প্রকাশকাল: বুধবার, ৫ মে ২০০৪ইং

কোন মন্তব্য নেই: