আমরা জানি প্রতিটা জিনিসেরই সুবিধা ও অসুবিধা আছে। অর্থাৎ যার দোষ আছে তার গুণও আছে। আমাদের দেশ বর্তমানে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এই মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হলে শুধু যে সুবিধাই ভোগ করবে তা নয়। এর কিছু অসুবিধাও আছে। এখন আমার মূল বিষয় হচ্ছে এর সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আলোচনা করা। তবে এর সুবিধা আলোচনা করার পূর্বে আমাদের জানা প্রয়োজন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার বলতে আমরা কি বুঝি।
মন্ত্রী পরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার হচ্ছে, যে শাসন ব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সর্ম্পক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শাসন বিভাগের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা আইন বিভাগের উপর নির্ভরশীল। অন্যভাবে বলা যায়, যে শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং মন্ত্রীপরিষদ তাদের কাজের জন্যে আইন সভার নিকট দায়ী থাকে তাকে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার বলি। আর রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন একজন নামমাত্র প্রধান হিসেবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদটি থাকে মুখ্য হিসেবে।
এখন মন্ত্রী পরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকারের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করছি। তবে প্রথমে সুবিধার দিকে আলোকপাত করা হলো।
১। এ শাসন ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সু-সর্ম্পক গড়ে উঠে। আর এ রকম শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতিকে স্বীকার করা হয় না।
২। এখানে মন্ত্রীসভা আইন সভার নিকট দায়ী থাকে। আইন সভার সদস্যগণ জনগণের নিকট দায়ী থাকে। আইন সভার আস্থা হারানোর ভয়ে এবং বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে মন্ত্রীগণ স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না।
৩। এখানে প্রত্যেক মন্ত্রীকেই নিজ নিজ কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে হয়। আর এরূপ জবাবদিহিতার ফলে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা সুশাসনে পরিণত হয়।
৪। এ শাসন ব্যবস্থা বিশেষ করে নমনীয়। কেননা প্রয়োজনবোধ এ সরকার ব্যবস্থায় যে কোন নীতি ও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন সহজেই করা যায়। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান আইনসভা ভেঙ্গে দিতে পারে।
৫। এ ধরণের শাসন ব্যবস্থায় জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
৬। এ শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভাই হল প্রকৃত শাসক। আর মন্ত্রীসভা জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। ফলে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই সরকারি নীতি নির্ধারিত হয় ও শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
৭। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার সদস্যগণ আইনসভায় উপস্থিত হয়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়নের কাজে আইন সভা সুষ্ঠু নেতৃত্ব দেন। আইন সভাও যে নেতৃত্ব মেনে নেয়।
৮। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় যোগ্য ব্যক্তিকেই মন্ত্রীপরিষদের সদস্য করা হয়।
৯। মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সময়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়। কেননা কোন মন্ত্রীপরিষদ নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে কার্যভার গ্রহণ করলে যে কোন সময় এ স্থলে অন্য কোন মন্ত্রী পরিষদকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়।
১০। এখানে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বাদানুবাদ ও আলোচনা আর বোঝা-পড়ার ভিত্তিতে সুশাসন সম্ভব হয়।
১১। এ শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে যতটা মর্যাদা দেয়া হয় অন্যকোন শাসন ব্যবস্থায় ততটা মর্যাদা দেয়া হয় না। আর বিরোধী দল সরকারকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দান করে থাকে।
১২। এ শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সরকারি কার্যক্রমে অধিক অংশ গ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকে, তেমনিভাবে সরকারও জনগণের কল্যাণ কামনা করে কাজ করতে থাকে।
১৩। এ শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শুধু মন্ত্রীসভার নেতা নন, আইন সভারও নেতা। তার ফলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বোধীন আইন সভা অতি সহজে আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়।
এতক্ষণ মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে আলোচনা করলাম। এবার আসা যাক এর দোষ-ত্রুটি বা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা।
১। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় ঘন ঘন মন্ত্রীসভার পরিবর্তনের আশংকা থাকে।
২। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। কারণ সরকারি সকল সিদ্ধান্ত মন্ত্রীসভার বৈঠকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গৃহিত হয়।
৩। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বেশি হয়। কারণ মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব আইন সভার সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। তাই মন্ত্রীরা তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে আইন সভার সদস্যদের কোন উপায়ে সন্তুষ্টু রাখতে অধিক মনোযোগী হয়।
৪। এ শাসন ব্যবস্থায় প্রায়ই শাসনকার্য বিঘিœত হয়। কারণ মন্ত্রীদের একই সময় আইনসভা ও নির্বাচন এবং নির্বাচকমন্ডলীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।
৫। এ সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে অস্থায়ী। কারণ এতে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের আস্থার উপর নির্ভরশীল থাকে। যদি আইনসভা তার আস্থা হারায় তাহলে সরকারের পতন ঘটে।
৬। যেসব চতুর ব্যক্তি মিথ্যা প্রলোভনের দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে, সেই নির্বাচনে জয়ী হয়। ফলে আইন সভায় অযোগ্য নির্বাচিত হয়ে আসে।
৭। বহুদল ব্যবস্থা প্রচলিত দেশে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার স্থায়ী হয় না। কারণ আইন পরিষদের বিভিন্ন দলের সদস্যগণ একত্রিত হয়ে এ সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটায়।
৮। মন্ত্রী পরিষদে একনায়কতন্ত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে মন্ত্রীসভা তাদের ইচ্ছেমত আইন পাস করিয়ে নেয়।
৯। এ সরকার ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ট দলই সরকার গঠন ও পরিচালনা করে থাকেন। আর এখানে দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয়। বিরোধী দল কিংবা জনমতের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।
১০। বহু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের ফলে অনেক সময় কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয় না। তখন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একাধিক দলের সমন্বয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার গঠিত হয়। আর তখন মন্ত্রীদের মধ্যে মত পার্থক্যের ফলে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা দুর্বল ও অস্থায়ী হয়ে পড়ে।
উপরোক্ত অসুবিধাগুলো ছাড়াও আরো অনেক অসুবিধা আছে। তারপরও পরিশেষে আমি বলব, কোন শাসন ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। প্রতিটি সরকার ব্যবস্থাই কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি রয়েছে। তাই মন্ত্রীপরিষদ শাসিত ব্যবস্থায় দোষ থাকা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। তবে আমি মনে করি অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে মন্ত্রীপরিষদ শাসন ব্যবস্থাই সবচেয়ে ভালো। এ শাসন ব্যবস্থায় দোষের চেয়ে গুণের পাল্লাই ভারি। সুতরাং এ শাসন ব্যবস্থাকে নি:সন্দেহে একটি উত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা বলতে পারি।
প্রকাশকাল: বুধবার, ১২ মে ২০০৪ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন