রাত বারটা।
চারদিকে নীরব নিস্তদ্ধতা। কোথাও কেউ নেই। এ মুহূর্তে গ্রামের কেউ এখন জেগে নেই। এমন সময় রুমা একা ঘর থেকে বের হলো প্রস্রাব করার জন্য। স্বামী শিহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আছে। চারপাশ থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শুনা যাচ্ছে। রুমা যখন বাথরুমে গিয়ে বসল ঠিক তখনই উপর থেকে একটা খচখচ আওয়াজ হলো। রুমা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কে, কে ওখানে।
কোন শব্দ নেই। আবার রুমা প্রস্রাব করতে বসল। আবার খচখচ আওয়াজ আসলো। তখন আবার বলল, কে, কে ওখানে।
এবারও কোন শব্দ নেই। রুমা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। আবার দাঁড়িয়ে গেল। এবার প্রস্রাব না করেই সামনের দিকে পা বাড়াল। সামনের দিকে তাকিয়েই দেখে সাদা ধূতি পড়া এক বয়স্ক লোক। দাঁতগুলো ইয়া বড় বড়। আঙ্গুলের নখগুলো বেশ বড়। লোকটা শুন্যে ভাসছে। পা দুটো মাটি থেকে উপরে। ভয়ংকর চেহারার এই লোকটি রুমার দিকে এগিয়ে আসছে। রুমা যত সামনে যাচ্ছে ভয়ংকর লোকটা ততই সামনে আসছে। লোকটা একসময় রুমার কাছাকাছি এসে একটা অট্টহাসি দিল। তারপর রুমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তুকে আমি এখন খেয়ে ফেলব।
এই কথা শুনে এবং ভয়ংকর লোকটাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল রুমা। তার চিৎকার শুনে শিহান ঘুম থেকে সজাগ হয়ে গেলো। চোখ মেলে শিহান দেখে রুমা বিছানায় নেই। দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাথরুমের কাছে রুমা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে বাড়ীর অন্যান্য লোকজনও সজাগ হয়ে গেল। কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসল। রুমার শ্বাশুরি বিলকিস বেগম ছুটে আসলেন। শিহান লাইট নিয়ে রুমার কাছে গিয়ে দ্রুত তাকে কুলে নিল। রুমার মুখ থেকে লালা পড়ছে আর গোংগাচ্ছে। কিন্তু কথা বলছে না। তারপর সবাই ধরাধরি করে রুমাকে ঘরে নিয়ে আসল।
পাশের বাড়ী থেকে রুমার চাচা শ্বশুর ছুটে আসলেন। শিহান বললেন, চাচা দেখেন রুমার কি হয়েছে। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
চাচা দোয়া কলাম পড়ে রুমাকে ঝারফুঁক দিলেন। শ্বাশুরি মাথায় পানি দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কিন্তু কোন কথা বলছে না।
চৌয়ালা গ্রামের রমিজ উদ্দিনের মেয়ে রুমা। খুবই শান্ত ছিল। এসএসসি পাশ করার পর পাশের গ্রামের মোতালিব মাস্টারের ছেলের সাথে তার বিয়ে দেন কয়েক মাস আগে। এমন লক্ষèী বউ পেয়ে মোতালিব মাস্টার ও বিলকিস বেগম খুব খুশী হয়েছেন। পাড়া প্রতিবেশীরা তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। মোতালিব মাস্টারের গ্রামটি ছিল ঘন গাছগাছলায় ভরপুর। বাড়ীর দু’পাশে দুটো চৌচালা টিনশীট ঘর। পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল বড় বাঁশঝাড়। এর পাশেই একটি ঘর। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর রমিজ উদ্দিনের মা বাবার কবর। দক্ষিণ পাশে কলার বাগান। এর পাশে আরেকটি ঘর। উত্তর পাশে বাথরুম। এর পাশেই কাঠবাগান। পশ্চিম পাশে তার বড় ভাইয়ের বাড়ী। দক্ষিণ ভিটার ঘরে শিহান তার বউকে নিয়ে থাকে।
পরদিন সন্ধ্যায় শিহান রুমার ঘরে গেল। শিহান রুমার শরীরে স্পর্শ করতেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল। কেমন জানি হয়ে গেলো রুমা। স্বামীকে বলছে, এই ব্যাটা তোর কত বড় সাহস আমার গায়ে হাত দিচ্ছিস। তুকে এক থাপ্পর মেরে বত্রিশ দাঁত ফেলে দিব। যা আমার ঘর থেকে চলে যা। আমি এখন আমার স্বামীর সাথে রাত কাটাব।
একথা শুনে শিহান আশ্চার্য হয়ে বলল, এসব কি বলছ তুমি, কে তোমার স্বামী?
রুমা অট্টহাসি হেসে বলল, তুকে বলব কেন?
আমি তোমার স্বামী শিহান।
কে শিহান? তাকে আমি চিনি না। হি হি হি।
তারপর শিহান বুঝতে পারল তার স্ত্রীকে জিনে ধরেছে। এভাবে কয়েকদিন চলল। দিন দিন রুমার অস্বাভাবিক আচরণে পাড়া প্রতিবেশী অতিষ্ট হয়ে গেলো। শ্বশুর শ্বাশুরিকে তুই তোকারি করে কথা বলে। স্বামীকে তার সাথে থাকতে দেয় না। প্রতিবেশীদেরকে গাল মন্দ করে। এমনকি অনেকের গায়ে থাপ্পরও মারে। খাওয়া দাওয়ায় তেমন মনযোগ নেই। গোসল ঠিক মতো করে না। দিন দিন যেন তার শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কে জানে। নতুন বউ এমন আচরণ করে তা কি করে তার শ্বশুর শ্বাশুরি সৈহ্য করবে? তার আবোল তাবুল কথায় বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নিশ্চয় কোন অশরীরী কিছু ভর করেছে নাহলে এমন করবে কেন? যে বউ কোনদিন বাড়ীর কারো সাথে কোন কটু কথা বলেনি সে কিনা এখন বকাঝকা করে। মারধর করে। তুই তোকারি করে কথা বলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। প্রতিবেশীরা কানাকানি করছে নিশ্চয় কোন জিনে ধরেছে। তা না হলে এমন করবে কেন?
রুমার চাচা শ্বশুর বেশ কয়েকদিন ঝারফুঁক করল কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন রুমার অত্যাচার বেড়েই চলছে। তার অত্যাচার সৈহ্য করতে না পেরে শিহান তাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
রুমার বাবা রমিজ উদ্দিন পাশের গ্রামের এক মাওলানাকে ডেকে আনলেন। তিনি জিন-ভূত তাড়াতে পারেন। তার অনেক নাম ডাক। ইতোপূর্বে অনেকেরই জিন-ভূত তাড়িয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। মাওলানা সাহেব রমিজ উদ্দিনের বাড়ীতে এসেই বললেন, আগে রুগীকে দেখান। দেখি কি হয়েছে। মাওলানা সাহেব রুমাকে দেখার জন্য ঘরে গেলেন। রুমা মাওলানা সাহেবকে দেখে বললেন, এই তুই আসছিস কেন? তোকে কে বলছে আসতে?
মাওলানা সাহেব বললেন, আমি তোর যম। তুই তাড়াতাড়ি এই রুগীকে ছেড়ে চলে যা। তা না হলে তুকে আজ মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলব।
রুমা হেসে উঠল। পারবি না।
আচ্ছা দেখা যাক। বলেই মাওলানা সাহেব বাইরে আসলেন। তিনি বুঝতে পারছেন রুমাকে কোন জিনে ধরেছে। এটা বড্ড দুষ্টু জিন। যাকে একবার ধরে তাকে একেবারে শেষ করে ছাড়ে।
মাওলানার আগমনে রুমার আচরণ আরো অস্বাভাবিক হয়ে গেলো। ঘরের ভেতর ছুটাছুটি করতে লাগল। আর জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, ঐ হুজুর বেটাকে বল, এ বাড়ি থেকে চলে যেতে। তা না হলে সবাইকে মেরে ফেলব।
রমিজ উদ্দিন ভয় পেয়ে গেল। মাওলানা আশ্বাস দিলেন ভয়ের কিছু কারণ নেই। যতবড় দুষ্টু জিনই তাকে ভর করুক না কেন সে আজ তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে নতুবা এখানেই তার দাফন হবে। তবে রুগীকে ঘর থেকে বের হতে দিবেন না। তাকে ঘরের মধ্যে দরজা দিয়ে আটকিয়ে রাখুন।
মাওলানার কথামত রুমাকে ঘরের মধ্যে বন্ধি করা হলো।
মাওলানা সাহেব উঠানে একটা গোল দাগ দিলেন। এর মধ্যে কোন দর্শনার্থীকে ঢুকতে দিবেন না। তারপর রুমাকে এই দাগের ভেতর বসানো হলো। দুজন দুপাশ থেকে তাকে ধরে আছে। পাড়ার সমস্ত মানুষ রুমার জিন তাড়ানো দৃশ্য দেখার জন্য হাজির হয়ে গেল। সবাই দাগের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল।
রুমা চিৎকার চেচামেচি করছে, আমাকে ছেঁড়ে দে। তা না হলে তোদের সবার ক্ষতি হবে।
মাওলানা সাহেব একটি ছুড়া পড়ে রুমার বুকের উপর ফু দিলেন। তারপর রুমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময় রুমা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল, খবরদার আমার হাত ধরবি না।
কিন্তু মাওনা সাহেব বড়ই সেয়ানা। এইসব দুষ্টু জিনকে তিনি ভয় পান না। তাই তার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রুমার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল চাপ দিয়ে ধরলেন। বল তুই কে?
ছেড়ে দে আমাকে।
না তোকে ছাড়বনা। বল তুই কে?
বলব না।
বলতে তোকে হবেই। তা না হলে আজ তোকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলব।
না না আমাকে মারবি না। আমি বলছি।
তাড়াতাড়ি বল।
বলছি। আমি সেন্টু।
মাওলানা বুঝতে পারছে সে মিথ্যে বলছে, তাই আবার বলল, না তুই মিথ্যে বলছিস। সত্যি করে বল তুই কে?
সত্যি বলছি।
না তুই মিথ্যে বলছিস। এই কথা বলেই রুমার আঙ্গুল জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন।
আমাকে মারবি না। বলছি। আমি হরমুজ।
এবার বল তুই কোথায় থাকিস?
উত্তর পাশে কাঠ বাগানে।
এখানে কেন এলি?
আমি বাগান থেকে এখান দিয়েই প্রতিদিন রাত বারটার সময় খাবারের সন্ধ্যানে দক্ষিণের দিকে যাই। যথারীতি আজও যাচ্ছিলাম। এই রাস্তায় তাদের বাথরুম। এমন সময় দেখি সে বাথরুমে ঢুকছে।
কিন্তু তোর সমস্যা কি ছিলো? কেন এই নববধুকে তুই ভর করলি?
তাকে দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল। তাই ওর উপর ভর করলাম।
তোর সাথে আর কে কে আছে?
আমার আরো পাঁচ বন্ধু আছে। তারা সবাই এখানেই থাকে।
তাহলেতো তোদের সবাইকে বোতলে ভরে মারতে হবে।
এটা করবি না। আমরা এখান থেকে চলে যাব।
তোরা কথায় কথায় মিথ্যে বলিস। তোদের কথার কাজে কোন মিল নেই। আজ তোকে সহ তোর পাঁচ বন্ধুকে পুড়িয়ে মারব।
এবার সত্যি বলছি আর কোনদিন এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় পা দিব না। আজকের মতো আমাকে মাফ করে দে।
বলেই রুমা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।
কাঁদলে কোন লাভ হবে না। বল কখন যাবি।
এখনই চলে যাব।
তোর পাঁচ বন্ধুকে বল চলে যেতে।
এখনই বলছি। তবে আমার আঙ্গুল ছেড়ে দে। তা না হলে কিভাবে যাব?
আমার সাথে চালাকি করছ? বলেই মাওলানা সাহেব আরো জোরে আঙ্গুল চেপে ধরলেন।
রুমা চেচামেচি করছে। তোর পায়ে ধরি। আমাকে ছেড়ে দে। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
ঠিক আছে তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু তুই যে চলে যাবি আমরা কিভাবে বুঝব? কি চিহ্ন রেখে যাবি।
ঐ যে কড়ই গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে দিয়ে যাব।
ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম বলেই রুমার হাত ছেড়ে দিল মাওলানা সাহেব। আর অমনি রুমা ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিক দিয়ে ঐ পাশ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেল। আর শো শো একটা আওয়াজ হলো।
রুমার মাথায় পানি দেয়া হল। এবার রুমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। শুয়া থেকে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে এত লোক দেখে বলল, আমি এখানে কেন? এত লোক কেন এখানে?
কেউ তার উত্তর না দিয়ে তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর মাওলানা সাহেব তাকে পড়া পানি ও বেশ কয়েকটি তাবিজ দিয়ে গেলেন। এগুলো যেন সব সময় তার সাথে রাখেন সেকথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তারপর থেকে রুমা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে লাগল। এক সময় সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে গেলো। চলে আসলো স্বামীর বাড়ীতে।
রচনাকাল: ১০ মার্চ ২০১৫ খ্রি:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন