বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

লাল গরু

ঈদুল আজহার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বড় ভাই কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর জামাল উদ্দিন কোন ঈদে কোরবানি দিতে পারেনি। আজ থেকে পনের বছর পূর্বে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন কামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন ভাবছে এবার নিজের পোষা লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর জামাল উদ্দিন ও স্ত্রী জরিনা বেগম তাদের শোবার ঘরে আসলো। জামাল উদ্দিন বালিশটা টেনে হেলান দিয়ে বসলেন। জরিনা বেগম একটি পান মুখে দিয়ে বললেন, কি ব্যাপার আইজকা এতো তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়বেন নাকি?
– না। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তার আগে আমারে এক খিলি পান দাও।
জরিনা বেগম সুপারি, জর্দা, খয়ার ও চুন দিয়ে পান বানিয়ে স্বামীর নিকট এসে বললো, নেন আপনার পান।
জামাল উদ্দিন পানটি হাতে নিয়ে মুখে দিল। জরিনা বেগম এবার বললো, বলেন কি বলবেন?
জামাল উদ্দিন পান মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে আর বলছে, ভাইয়া মারা যওয়ার পর এ পর্যন্ত কোনদিন কোরবানি দিতে পারি নাই। প্রতিবছরই তো মাংসের জন্য শিহান মাইনষের বাড়িতে গিয়া বইসা থাকে। তাই ভাবতেছি এইবার আমি কোরবানিতে শরিক হইব। এহন তুমি কি কও?
– কোরবানিতে শরিক হইবেন ট্যাহা কোথায় পাইলেন?
– ট্যাহা কোথাও পাইনি। লাল গরুটা বেইচ্ছা কোরবানিতে শরিক হইবো। আল্লাহর রহমে আমাগো গরুতো এখন চাইরট্টা। সামনের বছরটা গেলেইতো বাছুরটা বড় হইয়া যাইবো।
– আমারও তো ইচ্ছে করে কোরবানি দিতে। কিন্তু আপনার সমর্থের কথা চিন্তা কইরা কিছুই বলতে পারি নাই। শিহান প্রতি বছরই কোরবানির ঈদ এলে কাঁইন্দা বেড়ায়। এহন আমার কোন আপত্তি নাই। আপনি গরু বেইছতে পারেন।
স্ত্রীর সম্মতি পেয়ে জামাল উদ্দিন খুশি হয়ে বললো, তাইলে আজ আর কোথাও যাইবো না। এহন ঘুমাইয়া পড়ি। বাতিটা নিভাইয়া আহ।
জরিনা বেগম বাতি নিভিয়ে স্বামীকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। জরিনা বেগম মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও জামাল উদ্দিনের কেন জানি আজ ঘুম আসছে না। হঠাৎ করে তার ভাইয়ের কথা মনে হল।
কামাল উদ্দিন তখন নরসিংদীর ইউ.এম.সি জুট মিলে চাকরি করতেন। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এতই ভদ্র ছিলো যে জুট মিলের সকল কর্মচারীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু কতিপয় দুষ্ট লোক তার এই ভাল আচরণ মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেক চেষ্টা করেছে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে। কিন্তু যখন তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল তাকে মেরে ফেলবে। চাকরিতে যোগদান করার পর থেকেই কামাল উদ্দিন তাঁর স্ত্রী জরিনা বেগমকে নিয়ে জুট মিলের নিকটই বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
জামাল উদ্দিন তার ভাইকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে নরসিংদী আসতো। তেমনি একদিন সে বাড়ি থেকে ভাইয়ের জন্য শাক সবজি ও কিছু প্রিয় খাবার নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ান হলো। প্রতিমধ্যে খবর পেলো তার ভাই কামাল উদ্দিন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এই খবর শোনার সাথে সাথে তার হাত থেকে সব কিছু পড়ে গেলো।
কামাল উদ্দিনের লাশ বাড়িতে আনা হল। তার লাশ দেখার জন্য গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে। এমনকি অন্য গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আসল। লাশ নিয়ে যখন গোরস্থানে যাচ্ছে তখন তার বাবা রহম উদ্দিনের চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে লাগল। এ কেমন দৃশ্য! পিতার কাঁধে ছেলের লাশ! এ দৃশ্য কোন বাবা কামনা করতে পারে না। এ শোক কিভাবে সইবে রহম উদ্দিন? সবাই লাশ দেখার পর দাফন করা হয়।
এদিকে জামাল উদ্দিন সবে মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। তার ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে খুবই মর্মাহত। কারণ সংসারের সমস্ত বোঝা তার মাথায় নিতে হচ্ছে। বাবা-মা বৃদ্ধ। তার আর কোন ভাইও নেই যে, তার দায়িত্ব নিবে। তাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জামাল উদ্দিন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দু’টো গরু কিনে কৃষি কাজে লেগে যায়।
রহম উদ্দিনের বড় আশা ছিল কামাল উদ্দিন লেখাপড়া করে, চাকরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যায়।
কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর তিন মাস পর জরিনা বেগমের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হলো। রহম উদ্দিন পুত্র সন্তান জন্ম হওয়াতে খুবই খুশি হয়েছে। কারণ তার ছেলের বংশধর তার মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। জরিনা বেগম তার সন্তানের নাম রাখলেন রাকিব।
সময় থেমে থাকেনি। দিনের পর রাত আসে। তারপরে সপ্তাহ পার হয়। এভাবে চলে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দিনে দিনে বড় হতে লাগল রাকিব। রাকিবের দু’বছর পূর্ণ হল। এদিকে জরিনা বেগম প্রাণের প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পিতৃতুল্য শ্বশুরের অনুরোধে এ বাড়িতে রয়ে গেলেন।
রহম উদ্দিন চিন্তায় অস্থির। এভাবে আর কতদিন বউমা থাকবে? তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যে নারী কোন দিন শ্বশুরের মনে আঘাত দেয়নি, শশুরের একবিন্দু কষ্ট হতে দেয়নি। সেই নারীকে কীভাবে রহম উদ্দিন বিদায় দিবেন। এমন আদর্শ পরহেযগার সতী নারীকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায় না। তাকে যেভাবে হোক এ বাড়িতে রাখতে হবে। কামাল উদ্দিনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শিশু সন্তান রাকিবকেই বা কি করে দিয়ে দিবে। আর যদি নাতিকে রাখতে চান তাহলে কে করবে তার দেখা শুনা? এসব ভাবছেন রহম উদ্দিন। এবার এও ভাবছেন জামাল উদ্দিন বর্তমানে বিয়ের উপযুক্ত। তাকে তো অন্য জায়গায় বিয়ে করাতে হবে। সে বউতো রাকিবকে অন্য নজরে দেখবে। তার চেয়ে বরং জামাল উদ্দিনকে দিয়ে বউমাকে রেখে দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ ভালই হয়। এক ঢিলে দুই পাখি।
রহম উদ্দিন একদিন জামাল উদ্দিনকে ডেকে বললো, বাজান, আমার বয়স তো ফুরাইয়া যাইতেছে। জানি না কোন দিন মইরা যাই। তোকে আমার জীবনের শেষ একটি আবদার রাখতে হবে।
জামাল উদ্দিন নম্র স্বরে বললো, আব্বা আপনার সব আবদার আমি হুইন্না আইছি। আজও হুনবো। বলেন আপনার কি আবদার।
– আমি চাই তুই তোর ভাবিকে বিয়া কর। ও যদি চইলা যায় তাইলে তোর ভাতিজার কি হবে? সে কারে মা ডাকবে? সে জন্ম হয়ে তার বাপকে দেহেনি। এহন যদি মাকেও হারায় তাহলে তার মত অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কামাল উদ্দিনের অবর্তমানে তুই ওর বাপ। আমার আয়ু তো শেষ হয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না।
পিতৃভক্ত জামাল উদ্দিন কোন দিন কোন কাজে তার বাবার মনে আঘাত দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন কথা অমান্য করেনি। কি করে পারবে আজ বাবার শেষ আবদার ফেলে দিতে। শত কষ্ট হলেও পারবে না তার বাবার আবদারকে অপমান করতে।
রহম উদ্দিন আবার বলল, আমি জানি বাজান, বউমার চেয়ে তোর বয়স কম হবে। তারপরও সবদিক চিন্তা করে আমি তোকে বিয়া করতে কইছি। তোর ভাল হইবে।
জামাল উদ্দিন তার বাবার কথাগুলো শ্রবণ করে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো, দেখেন আব্বা এত কিছু কইতে হইবে না। আপনি যা ভালা মনে করেন তাই করেন। আমার কোন আপত্তি নাই।
রহম উদ্দিন একইভাবে জরিনা বেগমের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেন। জরিনা বেগম শুধু ছেলে ও শশুরের দিকে চেয়ে এ বিয়েতে সম্মতি দেয়।
বিয়ে হয়ে গেল জামাল উদ্দিনর সাথে জরিনা বেগমের। জামাল উদ্দিন তার বাবার কথা রাখতে গিয়ে, ভাতিজাকে মা ডাকার অধিকার দিতে গিয়ে, সদ্য ফুটে উঠা যৌবন খানা বিলিয়ে দিলেন তার চেয়ে বয়সে বড় একটা মহিলার মাঝে। যাকে সে এতদিন ভাবি হিসেবে জানত। আজ সে তার স্ত্রী।
ভাই মারা যাবার পর জামাল উদ্দিনের সংসারে অভাব শুরু হয়। বাবা রহম উদ্দিন বয়সের ভারে দিন দিন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এখন তেমন বেশি চলাফেরা করতে পারেনা। এখন শুধু মসজিদ ছাড়া আর কোথাও যেতে পারেন না। তার মা কিছুদিন আগে মারা যায়।
দেখতে দেখতে দু’বছর পার হয়ে গেল। জামাল উদ্দিনের সংসারে একটা কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সন্তান দুনিয়াতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। হঠাৎ একদিন নিউমোনিয়া হয়ে মারা যায়। দিন মজুর জামাল উদ্দিন তার সন্তানের সু-চিকিৎসা করতে পারেনি। সন্তান হারিয়ে বুকে ব্যথা নিয়ে রাকিবকে সন্তানের মত করে লালন পালন করতে লাগলেন। নিজে একা পরিশ্রম করেন তবু রাকিবকে কাজে নেননি। ওর বয়স যখন ছয় বছর হলো তখন তাকে নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলো।
জামাল উদ্দিনের মেয়ের জন্মের তিন বছর পর শিহানের জন্ম হয়। যে দিন শিহান জন্ম হল সেদিন তার ঘরে এক মুঠো ভাতও ছিলনা। শিহান জন্মের পর থেকে তার সংসারে অভাব বেশি করে দেখা দেয়। যা কিছু জমি জমা ছিল তাও বিক্রি করে শেষ করে ফেলল। এই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে শিহান বড় হতে লাগল। এখন তার নিজের জমি বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে চারটি গরু দিয়ে মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করে কোন মতে দিন চলছে। এই অভাবের সংসারে শিহানকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ হারিয়ে ফেললো সে।
রাকিব একদিন মাদ্রাসা থেকে একা বাড়িতে আসার পথে হারিয়ে যায়। পিতৃহারা সন্তান রাকিবকে হারিয়ে জরিনা বেগম এখন দিশেহারা। প্রাণ প্রিয় প্রয়াত স্বামীর মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই ছেলে আবার নিরুদ্দেশ। তার কান্না সহ্য করতে না পেরে জামাল উদ্দিন কয়েকবার নরসিংদী এসে খুঁজে যায়। শহরের কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সে।
মুয়াজ্জিনের আজানের সুরে স্বামী-স্ত্রীর দু’জনের ঘুম ভাঙ্গল। জামাল উদ্দিন যথারীতি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো। তার বাবা রহম উদ্দিনও নামাজ পড়তে গেলেন। তিনি এখন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। মসজিদটা বাড়ির কাছে বলে সেখানে কোন মতে যেতে পারেন। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তিনি দুর্বল হয়ে গেলেন। ওনার বয়স এখন ৯০ বছর চলছে। মনে হয় না যে আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন। নামাজ পড়ে এসে রহম উদ্দিন খাটে শুয়ে আছেন। জামাল উদ্দিন তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন। রহম উদ্দিন জামাল উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু কইবি বাজান?
জামাল উদ্দিন মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আব্বা কিছু কথা কমু।
– কি কইবি?
– আব্বা আমি নিয়ত করেছি এইবার ঈদে লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হইব। আপনি কি কন?
– আমার কিছু কওয়ার নাই। আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। এহন তুই যা ভালা মনে করছ তাই কর।
– আপনার কোন আপত্তি নাই তো?
– না।
জামাল উদ্দিন আর কোন কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে চলে গেল।
সকাল বেলা শিহান, জরিনা বেগম ও জামাল উদ্দিন এক সাথে খেতে বসলেন। কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই শিহান বললো, আব্বা লাল গরু বেইচ্ছা আমার জন্য কি আনবেন?
জামাল উদ্দিন বললো, তুই ক তোর জন্য কি আনবো?
– আমার জন্য একটা লাল গেঞ্জি ও লাল হাফপ্যান্ট আনবেন। আর একটা লাল কাগজের টুপি।
– আর কিছু লাগবে না?
– না।
– তোর আম্মার জন্য কি আনবো?
– আম্মার জন্য লাল শাড়ী।
– দাদার জন্য?
– লাল পাঞ্জাবী আর লাল পায়জামা।
– তুই শুধু সব কিছুই লাল কিনতে কছ ক্যান?
– আব্বা আপনি জানেন না। আমি লাল গরুকে কত্ত ভালোবাসি। আপনি আমার লাল গরুকে বেইচ্ছা দিবেন। তহন আমি থাকুম কিভাবে? সব গুলান যদি লাল হয় তাইলে আমি লাল দেইখা থাকতে পারুম।
– ঠিক আছে বাজান।
শিহান জামাল উদ্দিনের একমাত্র ছেলে। তার এখন ৮ বছর বয়স। এখনও স্কুলে যায় না। পড়ার কথা বললেই সে গরু নিয়ে মাঠে চলে যায়। তাই সে শিহানকে একটা ছাগল কিনে দেয়। তাদের গ্রামের উত্তর পাশে এক বিরাট চর। তার কাজ এই চরে গরু ও ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো। আর মাঝে মাঝে বাবার সাথে খেত নিড়াইতে যায়। বাবা কাজ করতে গেলে চরে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যায়। শিহান লাল গরুটাকে খুব বেশি ভালোবাসে। এবার সেই লাল গরুটা বিক্রি করে দিবে তাইতো তার মনে কষ্ট। তারপরও যেহেতু এইবারই প্রথম কোরবানি দিবে। সেই কথা চিন্তা করে সে মহাখুশি।
আজ শুক্রবার। পাশের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি এসে জামাল উদ্দিনকে বললো, কিরে জামাল, তোর লাল গরুটা নাকি বেইচ্ছা লাইবি?
জামাল উদ্দিন বললো, হ চাচা। ভাবছি এইটা বিক্রি কইরা শরিক হইব।
মুরুব্বিদের মধ্যে একজন বললো, তা ভালা কথা আমডা ছয়জন আছি। আরেক জন লোক চাইতাছি। তুই আমাগো লগে থাকতে পারস। আর তুই রাজি থাকলে তোর লাল গরুটা দাম দর করে কোরবানি দিয়ে দেই। হুদাহুদি বাজারে কষ্ট কইরা নিয়া কোন লাভ নাই।
– আপনারা মুরুব্বি মানুষ। আপনারা যা ভালা মনে করেন তাই করেন।
অন্য একজন মুরুব্বি বললো, তো কত দিতে হবে দাম?
আমি কি কমু চাচা। কতর মাল আছে তা আন্দাজ কইরা দিয়া দেন।
অন্য একজন বললো, আটাশ হাজার ট্যাকা দিমু। তোর কোন আপত্তি আছে?
– চাচা ত্রিশ হাজার দিলে হয় না?
– না আটাশ হাজার ট্যাকা মিল আছে। ৭ জনে চার হাজার ট্যাকা করে পরবে। তুই আর কোন আপত্তি করিস না। আল্লাহ রাস্তার নিজের পালা গরু কোরবানি দিবি আল্লাহ অনেক ছোয়াব দিবে।
– ঠিক আছে চাচা। তাইলে কথা তাই রইল।
– আর হোন তোর চার হাজার ট্যাকা বাদে বাকি চব্বিশ হাজার টাকা কাল্কা দিমু।
– ঠিক আছে।
জরিনা বেগম মুড়ি, চানাচুর নিয়ে এসে বললো, আপনারা হগলতে মুড়ি, চানাচুর খান।
একজন মুরুব্বি বললো, আরে তুমি আবার এইসব আনতে গেলে ক্যান?
জামাল উদ্দিন বললো, গরিবের বাড়িতে আসছেন আর কি দিমু। সামান্য কিছু দিলাম।
মুড়ি, চানাচুর খাওয়ার পর একজন বললো, এহন যাইরে জামাল। কাল্কা সহালেই তোর ট্যাহাটা দিয়া দিমু।
– তাই কইরেন চাচা। কাল্কা শনিবার তো বাজার সদাই করতে হবে।
– ঠিক আছে। এই বলেই মুরুব্বিরা সবাই চলে গেল।
জামাল উদ্দিন স্বপ্ন দেখছে এবারের ঈদটা একটু আনন্দে কাটাবে। শিহান স্বপ্ন দেখছে লাল জামা পড়ে ঈদ করবে। জরিনা বেগমের মনেও আজ আনন্দ।
ফজরের আজান দিতেই জরিনা বেগমের ঘুম ভাঙ্গল। নামাজ পড়ে তিনি গোয়াল ঘরে গেলেন গোবর ফালানোর জন্যে। গোয়াল ঘরে ঢুকতেই দেখে লাল গরুটি নেই।
– হায় আল্লাহ! একি করলা তুমি? বলেই জরিনা বেগম চিৎকার দিয়ে উঠলো।
জামাল উদ্দিন স্ত্রীর চিৎকার শুনে দ্রুত আসলো। লাল গরুটিকে না দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিছুই বলতে পারছে না। জারিনা বেগম কাঁদছেন।
– হে আল্লাহ কি অপরাধ করেছিল আমার সোয়ামী? কি অপরাধ করেছিল আমার শিহান? যার জন্যে তুমি আমাগো প্রতি এমন অবিচার করছো?
শিহান তখনও ঘুমাচ্ছিল। মায়ের চিৎকার শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে আসল।
– আম্মা তুমি কাঁন্দ ক্যান?
– বাজানরে তোর লাল গরুটা চোরে নিয়া গেছে।
– কি কও আম্মা!
শিহান ঘোয়াল ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি লাল গরুটি নেই। তারপর জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।
– তাইলে আম্মা আমার আর লাল জামা কিনা হইব না?
জরিনা ও বাবুলের কান্নায় বাড়ির আশে পাশের লোকজন এসে ভিড় জমালো। সবাই গরুটার জন্যে আফসোস করতে লাগল।
শিহান রহম উদ্দিনের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো, দাদা আমি আর নতুন জামা পড়ে ঈদে যেতে পারুম না।
রহম উদ্দিন নাতির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নাতির কান্না দেখে বৃদ্ধ দাদার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল খসে পড়ল।
জামাল উদ্দিনের কত স্বপ্ন ছিল গরু বিক্রির টাকা দিয়ে নতুন জামা আনবে। কোরবানিতে শরিক হবে। আনন্দে ঈদ করবে কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে গেল। যারা গরুর দাম ঠিক করছিল তারাও আসলো। জামাল উদ্দিনকে শুধু সান্ত¡না ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না তারা।
আজ সারাদিন জামাল উদ্দিন মনমরা হয়ে বসে আছে। কারো সাথে কোন কথা বলেনি। কত লোকজন বাজারে গিয়ে ঈদের কেনাকাটা করল। কোরবানির গরু কিনল। কিন্তু জামাল উদ্দিন কিছুই কিনতে পারলো না। পাশের বাড়ির বিশিষ্ট শিল্পপতি এম.এ মতিন সাহেব ১ লক্ষ টাকা দিয়ে মোটা তাজা দেখে একটি গরু কিনে আনলেন। গ্রামের যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর সবাই ঐ গরু দেখতে গেল। শিহানও তাদের দেখাদেখি গরু দেখতে গেল।
আজ ঈদ। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা বইছে। সবাই আজ ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু জামাল উদ্দিনের পরিবারে নেই কোন আনন্দ। নেই কোন ঈদ। এদিকে রহম উদ্দিনের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। জরিনা বেগম ও শিহান তাঁর পাশে বসে চোখের পানি ফেলছে। যে শ্বশুর কোনদিন জরিনাকে কোন কটু কথা বলেনি। সারাক্ষণ তাকে শধু বউমা বলেই ডেকেছে, সে শ্বশুর আজ মৃত্যু পথের যাত্রী। তা জরিনা বেগম ভাবতেই চোখের জল এসে যায়।
সকাল ৭ টায় রহম উদ্দিন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য পরদেশে চলে গেলেন। যিনি আর এই পৃথিবীতে আসবেন না। এমন একটা ঈদের দিনে, খুশির দিনে তার মৃতুত্যে বাড়িতে কান্নার রুল পড়ে গেল। শিহান দাদা…দাদা… বলে চিৎকার করছে। এ চিৎকার প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পিতার মৃত্যুতে জামাল উদ্দিন একেবারে বোবা হয়ে গেছে। কথায় আছেÑ ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।’ বাড়ির আশে পাশে শোকের ছায়া পড়ে গেল। ইমাম সাহেব এসে বললো, ঈদের নামাজের পর ঈদগাহের মাঠে জানাজার নামাজ সম্পূর্ণ করবে। তাই তাড়াতাড়ি গোসল করানোর জন্য বলে গেল। ঈদের দিন মৃত্যুবরণ করায় দূরের আতœীয় স্বজনরা কেউ আসতে পারে নি। নয়টায় ঈদের জামাত হবে। মাত্র দুই ঘন্টা ব্যবধানে তাকে দাফন করানোর জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হল। ঈদের নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হল। হাজার হাজার গ্রামবাসী জানাজায় অংশ গ্রহণ করল। শিহান কালো একটা হাফপ্যান্ট ও শার্ট পড়ে ঈদগাহে আসে। নামাজ শেষে রহম উদ্দিনকে কবর দিয়ে জামাল উদ্দিন শিহানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
সবাইতো আজ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত। দু’একজন হয়তো তাদের শোকে শোকাহত। হতভাগা জামাল উদ্দিনের জীবনে এমন করুণ পরিণতি আসবে তা সে ভাবতেও পারেনা। জীবনের প্রতিটি পদে পদে তাকে আল্লাহ কষ্ট দিয়েছে। সে যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার বাবা চাকুরি হারান। আর তখন থেকেই তাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়। যখন লেখাপড়া করে ভাল একটি চাকুরী করার স্বপ্ন দেখছিল, তখন সে তার ভাই জামাল উদ্দিনকে হারায়। তারপর আসে তার জীবনে করুণ পরিণতি। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ভাবীকে বিয়ে করে সংসারি হতে হয়েছে তাকে। অভাবের তাড়নায় নিজের ছেলেকেও লেখাপড়া করাতে পারে নি। আজ এমন খুশির দিনেও খোদা তার সুখ সইল না। গরু চুরি হল। বাবা মারা গেল। একি খোদার ইনসাফ! কেন এত বড় শাস্তি দিলো তাকে? কেউ কি দিতে পারবে তার উত্তর? আসলে বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে আসে। আজ যেন জামাল উদ্দিনের সেই অবস্থাই হল।
জরিনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাঁধভাঙ্গা নদীর জলের মত অশ্রু তার চোখ বেয়ে পড়ছে। বার বার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।
ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা সবাই যার যার পশু কোরবানি করে নিল। অন্যান্য ঈদের মত শিহান এবার আর অন্যদের গরু জবেহ করা দেখতে যায় না। কারণ আজ যে সে দাদার মৃত্যু শোকে শোকাহত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সবার ঘরে ঘরে মাংস রান্না হচ্ছে। মাংসের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জরিনা বেগম রান্না ঘরে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জামাল উদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছে।
শিহান এসে বললো, আম্মা আমডা কি গোস্ত খাইতে পারুম না?
জরিনা বেগম নিরুত্তর।
শিহান আবার বাবার কাছে গিয়ে বললো, আব্বা আপনি মতিন সাবের বাড়ি থেকে গোস্ত নিয়া আসেন।
জামাল উদ্দিন বললো, বাজানরে একথা বলে আমারে আর কাঁদাসনে। আমাগো ভাগ্যে আজ গোস্ত জুটবে না। আজ কি করে গোস্ত খামু? আজ যে তোর দাদাকে হারালাম।

২১/০৯/২০১৫খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: