মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬

কোরআন নাজিলের মাস রমজান


‘রমজান’ শব্দটি আরবি। এটি রামিদা আর রামাদান থেকে এসেছে। যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু মূলত এর অর্থ হচ্ছে ভস্ম করে দেয়া, ঝলসে দেয়া। ব্যাপক অর্থে রমজান বলতে, একজন রোজাদার রোজা রাখার ফলে, তার পাকস্থলীতে পিপাসার কারনে যে প্রখর তাপের সৃষ্টি হয়, সেটাকে বুঝানো হয়েছে। রমজানের আরেকটি অর্থ হল, রমজান মুসলিমের ভাল কাজের কারন ও এটি মুসলিমের সকল গুনাহকে পুড়িয়ে দেয়।
রমজান মাসের নাম রমজান হওয়ার কারণ হচ্ছে, সর্বপ্রথম রোজার বিধান যে মাসে এসেছিল সে মাসটি ছিল প্রচ- গরমের। ঝলসে দেয়ার মতো গরম, তাই এর নাম রাখা হয়েছে ‘রমজান’। তবে আলিমগণ বলেন, ‘বান্দা যেহেতু এ মাসের বিধানাবলি সুচারুরূপে পালন করে বিধায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত পাপকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দেন। তাই এ মাসকে ‘রমজান’ বলা হয়। আমরা সাধারণত মনে করে থাকি রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য শুধু ‘রোজা রাখা আর তারাবিহ পড়া। এগুলো রমজানের প্রধান দুটি ইবাদত বটে। 
পবিত্র রমজান কোরআন নাজিলের মাস। এতে কোন সন্দেহ নেই। কেবল কোরআনই নয়, এ মাসের সঙ্গে মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিম ও অন্য আসমানি কিতাবগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যে চারটি বড় আসমানি কিতাব নাজিল করেছিলেন, এর সবই মাহে রমজানে নাজিল করেছেন। তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এবং সর্বশেষ গ্রন্থ কোরআনে কারিম রমজান মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। রমজানের সঙ্গে কোরআনের শব্দগত ও মর্মগত বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত অসাধারণ মিল ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কোরআন হলো রমজানের নিগূঢ় তত্ত্ব; রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্কও সুগভীর। আল্লাহ রমজানের পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন এভাবে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থাৎ, রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।
এ কারণেই এ মাসকে কোরআনের মাস বলা হয়। কাজেই এ মাসের প্রধান আমল হলো কোরআন তেলাওয়াত। আরবি চান্দ্র বছরের বারো মাসের মধ্যে রমজান হচ্ছে নবম মাস। এই মাস ইসলামী জীবন বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ তাৎপর্যবাহী। আসমানী রহমতের বার্তা আর অফুরন্ত মাগফিরাতের আহ্বান নিয়ে এ মাস আমাদের মাঝে হাজির হয়। বছরের বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসের ফজিলত ও বরকত অনেক বেশি। মানব জাতিরা যখন সারা বছর আল্লাহর নাফরমানি করে কাটিয়ে দেয়, ঠিক তখনই সেসব ভুলের মাশুল দিতে ক্ষমার সেøাগান নিয়ে মানুষকে নিষ্পাপ আর পাপরাশিকে ভস্ম করার জন্য আগমন করেছে মাহে রমজান। 
রমজানে এমন একটি বিশেষ ইবাদত পালন আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন, যা তার নৈকট্যলাভের পথ সহজ করে তোলে। এই রমজান মাস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে হাজির হয়। এই মাসে একজন মুমিন বান্দা তার নেক আমল বৃদ্ধি করে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন নাজাত লাভ করতে পারেন। রমজানের শব্দগত অর্থের মধ্যে এই ধারণা নিহিত রয়েছে। রমজান সব অমঙ্গল ও পাপাচার দহন করে পুত-পবিত্র করার ক্ষেত্র তৈরি করে। 
ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে রোজা পালন অন্যতম। এটি একমাস ধরে মানুষের কু-বাসনা ও কামপ্রবৃত্তি দমন করার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তাই রমজান ও সিয়াম বিশেষভাবে পারস্পরিক সম্পর্কিত। এই দুয়ের মধ্যে দহন করার উপাদান বিদ্যমান। এক মাস রমজানের সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর এই বিশেষ গুণের কর্ষণ করে একজন সিয়াম পালনকারী তার আত্মার পরিশুদ্ধি লাভের সুযোগ পায়। সিয়াম পালন একজন রোজাদারের মালিন্য দূর করে এবং মানসিক প্রশান্তি বয়ে নিয়ে আসে। সিয়াম পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। সিয়ামের এই বিশেষ উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা, আয়াত:১৮৩)
রমজান মাসে কোরআন নাজিলের ব্যাপারে আল্লাহ পাক পবিত্র  কোরআনে ঘোষণা করেন-
  إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (১) 
 وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (২)
 لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ (৩)
 تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ  (৪)
سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (৫) 
অর্থাৎ “ (১) নিশ্চয় আমি তা (কুরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। (২) আপনি জানেন কি? কদরের রজনী কী? (৩) কদরের রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম! (৪) এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (৫) এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ” (সূরা কদর, আয়াত:১-৫) 
এ আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যায়, লওহে মাহফুজ থেকে শবে কদরে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর হজরত জিবরাইল (আ.) ধীরে ধীরে তেইশ বছরে তা রাসুল (সা.) এর কাছে পৌঁছাতে থাকেন। এ কথাও বলা যেতে পারে, এ রাতে কয়েকটি আয়াত অবতরণের মাধ্যমে কোরআন অবতরণের ধারাবাহিকতা সূচনা হয়। এরপর অবশিষ্ট কোরআন পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়।
আর কদরের রাত হলো রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত। ইসলামে স্বীকৃত বরকতময় ও মহিমান্বিত যেসব দিবস রজনী রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর। কদরের এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। অন্যান্য রাতের তুলনায় এ রাত মহিমান্বিত হওয়ার কারণে এটাকে লাইলাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতে আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেটা মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব এবং যে নবীর ওপর অবতীর্ণ তিনিও মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আর যে উম্মতের জন্য অবতীর্ণ করেছেন তারা মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। সর্বোপরি আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না, সেও এ রাতে তওবা ইস্তিগফার ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে মহিমান্বিত হয়ে যায়। কদরের আরেক অর্থ তাকদির ও আদেশ। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত তাকদির ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের হায়াত, রিজিক, ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাকে লিখে দেওয়া হয়।
রমজান মাসে আমরা পাঁচটি সুন্নত পালন করি। আর তা হলো- (১) সেহরি খাওয়া, (২) ইফতার করা, (৩) তারাবি নামাজ পড়া, (৪) কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করা, (৫) ইতিকাফ করা। 
উক্ত পাঁচটি সুন্নতের দুটিই হলো প্রাকৃতিক প্রয়োজন; যা মানুষ বাধ্য হয়ে করে থাকে। রোজা রাখার শক্তি সামর্থ্য অর্জনের জন্য সেহরি খাওয়া এবং রোজার ক্লান্তি ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য পানাহার বা ইফতার করা। মূলত শেষোক্ত তিনটিই হলো রমজানের মূল ইবাদত বা মৌলিক উদ্দেশ্য। আর এই তিনটির সঙ্গেই রয়েছে কোরআনের একান্ত সম্পর্ক। 
রমজানের তৃতীয় সুন্নত তারাবি নামাজ, এতে কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, যা নামাজের ফরজ ও ওয়াজিব রুকন এবং খতম তারাবিতে পূর্ণ কোরআন মজিদ খতম করা হয়, যা সুন্নত। 
রমজানের চতুর্থ সুন্নত কোরআন তিলাওয়াত। সাহাবায়ে কিরাম প্রায় সারা বছর প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার তিলাওয়াত করতেন। তাঁরা রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হজরত জিবরাঈল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং কোরআন শরিফ ‘দাওর’ করতেন অর্থাৎ রাসুল (সা.) ও জিবরাঈল (আ.) একে অন্যকে কোরআন শুনাতেন। (বুখারি : ১৯০২) 
রমজানের পঞ্চম সুন্নত হলো ইতিকাফ, যা মূলত আল্লাহর সঙ্গে নির্জনবাস বা গোপন অবস্থান। যার উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর সঙ্গে সঙ্গোপনে বিশেষ সান্নিধ্য অর্জন ও একান্ত আলাপচারিতা। কোরআন হলো কালামুল্লাহ বা আল্লাহর বাণী। কোরআন তিলাওয়াত হলো আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা। তাই ইতিকাফের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো কোরআন তিলাওয়াত।
এ ছাড়াও ইসলামি শরিয়তে ঈমানের পরই হলো নামাজ, নামাজের উদ্দেশ্য হলো জিকির বা আল্লাহর স্মরণ। কোরআন মজিদে এ বিষয়ে বলা হয়েছে,
 إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
অর্থাৎ আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামাজ কায়েম কর। (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াত: ১৪)। তাই নামাজের উদ্দেশ্যও হলো আল্লহর জিকির বা প্রভুর স্মরণ করা। 
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল রমজান শুধু কোরআন নাজিলের মাস নয়; বরং রমজান মাস হলো কোরআন প্রশিক্ষণের মাস এবং সর্বোপরি রমজান মাস হলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোরআন অনুশীলন ও বাস্তবায়নের মাস। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআন মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন!

তারিখ: ২০/০৬/২০১৬ইং

কোন মন্তব্য নেই: