রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

সৃজনশীল পদ্ধতিতে সিলেবাস জাতিকে মেধাশূন্য করছে

এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে দেশের প্রায় এসএসসিতে ৯০ শতাংশ ও এইচএসসিতে ৭১.১৩ শতাংশ পরিবার আনন্দে আত্মহারা। তাদের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করেছে, অনেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর চেয়ে বেশী খুশী আর কি হতে পারে। তারা সাংবাদিকদের সামনে এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হচ্ছে এ অভুতপূর্ব রেজাল্ট। সর্বোপরি সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা ও গ্রেটিং পদ্ধতিরও
প্রশংসা করেন তারা। তাদের কথা মতো বলা যায়, তাহলে আজ থেকে এক যুগ পূর্বে অর্থাৎ ১৯৯৯,২০০০ সালের যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তা মুটেও ভাল ছিল না? তখন শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীরা পরিশ্রম করতো না? তাদের মধ্যে মেবাধী ছাত্র-ছাত্রীদের অভাব ছিল? তাদের এসব কথার জবাবে আমি বলব অবশ্যই ছাত্রছাত্রীরা তখন পড়াশুনা করত। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আরো উন্নত ছিল। এখনকার চেয়ে তখনকার ছাত্র-ছাত্রীর মেধাবী ছিল বেশী। কারণ তখন তারা পড়াশুনা করত। কঠোর পরিশ্রম করে পাশ করতো। তখন যারা শতকরা ৩৪/৩৫ জন পাশ করতো তারা ছিল প্রকৃত ছাত্র। আর এখন যে এইচএসসিতে ৭১ জন ও এসএসসিতে ৯০ জন পাশ করে এর সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা সুন্দর করে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। তখন একজন ছাত্রকে প্রথম বিভাগ পাওয়ার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। আর এখন জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্যও এত পরিশ্রম করতে হয় না। এখন ছাত্র-ছাত্রীরা ফেসবুক, ব্লগ, কম্পিউটারে গেম খেলে ও মোবাইলে সারারাত কথা বলে সময় পার করেও অনায়সে পাশ করে যাচ্ছে। যা এক যুগ পূর্বে এত ব্যাপক ছিল না। ১৯৯৯ আমি যে প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন ৫০ জন ছাত্রের মধ্যে একমাত্র আমি প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। আর এখন সেই একই প্রতিষ্ঠানে ১৫ থেকে ২০ জন জিপিএ-৫ পাচ্ছে।

কিন্তু কথা হচ্ছে প্রায় ৯০ বা ৭১ শতাংশ পাশের পেছনে কি কারণ আছে। কি এমন পরিবর্তন এল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে, তারা এত মেধাবী ছাত্র হয়ে গেল? অনেকে হয়তো গ্রেডিং পদ্ধতিকে দায়ী করছেন। কিন্তু আমি বলব, প্রায় ৯০/৭১ শতাংশ পাশের পেছনে গ্রেডিং পদ্ধতি মুটেও দায়ী নয়। আমার মনে হয় না গ্রেডিং পদ্ধতিতে কোন ভুল আছে। যে কারণে এত বেশী জিপিএ পাচ্ছে সে কারণটি হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতিতে সিলেবাস তৈরি। এতে করে এখনকার ছাত্ররা পড়াশুনা করে না। প্রশ্ন দেখেই উত্তর দিতে পারে। এখন উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন বড় হয়। তাই ছাত্রদেরকে এখন আর নকল করার প্রয়োজন হয় না। প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর দেওয়া থাকে। পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনা। প্রশ্ন পেলে আর নকলের প্রয়োজন কী? বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নাম্বার বেশী দেয়ার জন্য পরীক্ষকদের উপর চাপ দেওয়া হয়। তাদেরকে বলা হয় পাশের হার বেশি দেখাতে হবে তাই আপনারা খাতায় লিখলেই নাম্বার দিবেন। পরীক্ষার খাতায় কি লিখলো সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আবার দ্রুত ফলাফল প্রকাশের জন্য উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় কম দেওয়া হয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী যেমন উপযুক্ত নাম্বার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি মেধাবিহীন শিক্ষার্থী ভাল গ্রেড পেয়ে পাশ করে যাচ্ছে। এই জন্যই আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা আজ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। আগে যেখানে একজন ছাত্র প্রথম বিভাগ পেতে হিমশিম খেত এখন একজন খারাপ ছাত্রই অনায়সেই জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছে। নিচের উদাহরণটি দেখলেই বুঝতে পারবেন কিভাবে এখন ছাত্র অতিসহজে জিপিএ-৫ পাচ্ছে। আগে যেখানে ছাত্রদের মুখস্থ করতে হতো এখন আর মুখস্থ করতে হয় না।
উদাহরণঃ
সৃজনশীল প্রশ্নঃ
গণি মিয়া একজন কৃষক। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তার তিন ছেলে চার মেয়ে। তিনি কঠোর পরিম্রম করে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি খুব সৎ ভাবে জীবন যাপন করেন।
ক) গণি মিয়া কে?                                                         ১
খ) বর্গা চাষ পদ্ধতি কি?                                                  ২   
গ) গণি মিয়ার ছেলে মেয়ে কত জন?                                     ৩
ঘ) গণি মিয়া কেমন প্রকৃতির লোক? ব্যাখ্যা কর।                       ৪

সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ

ক) গণি মিয়া একজন কৃষক।
খ) একজন কৃষক যখন অন্যের জমি ভাগাভাগিতে চাষ করে তখন তাকে বর্গা চাষ পদ্ধতি বলে।
গ) গণি মিয়ার তিন ছেলে ও চার মেয়ে।
ঘ) গণি মিয়া একজন সৎ ও ভাল লোক। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালান।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন উপরোক্ত চার প্রশ্নের উত্তর উদ্দীপকে লুকায়িত আছে। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কোন ছাত্র-ছাত্রীকে বই পড়তে হবে বলে আমি মনে করিনা। আর নাম্বার অঙ্কের মত দেয়া হবে। চার লাইন দেখে লিখতে পারলেই ১০ পাবে। যা এক সময় কল্পনার বাইরে ছিল। এভাবে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই জিপিএ-৫। আগে গণিত ছাড়া অন্য যেকোন বিষয়ে ৮০% নাম্বার পাওয়া একজন ছাত্রের জন্য কত যে কঠিন ছিল তা বলা বাহুল্য। সর্বোপরি শুদ্ধ বানানে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। হাতের লেখা সুন্দর ও গুছানো উত্তর দেয়ার পরও পরীক্ষকের কষ্ট হতো ৮০% নাম্বার দিতে। যারা সবগুলো বিষয়ে ৮০% নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হতো তাদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ নাম্বারের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ২০ জনের মেধাতালিকা করা হতো। আর এখন এসএসসিতে জিপিএ- ৫ পেয়েছে ৯১ হাজার ২২৬ জন ও এইচএসসিতে জিপিএ- ৫ পেয়েছে ৪৬ হাজার ৭৩৬ জন। শত শত জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকার নামী দামী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পাচ্ছে না। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষায় পাশ করে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমান রেজাল্ট দেখে বুঝা যাচ্ছে শিক্ষার মান যে কতটা নীচে চলে গেছে।
‘মেধাবী’ শব্দটার সংজ্ঞা কি? জিপিএ- ৫ পেলেই কি মেধাবী নাকি? বেশী বেশী জিপিএ- ৫ পেলেই কি শিক্ষার মান উন্নতি হয়। এখন ভেবে দেখার সময় হয়েছে এভাবে জাতি একদিন মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। পাশের হার যতই বাড়বে ততই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে। এখন যে হারে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দশ বছর পরে তা ভয়াবহ রূপ নেবে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার দিয়ে জাতি উন্নত করতে পারবে না। জাতিকে উন্নত করতে হলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি না করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। বেকারের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

রচনাকালঃ ১০ মে ২০১৩ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: