আজকাল সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই যে সংবাদটি সবার নজরে বেশি পড়ে তাহলো নারীরা পুরুষ কর্তৃক যত প্রকার নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যৌতুকের শিকার। বর্তমানে এ যৌতুক একটি প্রথা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা নারী সমাজের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের ফলে কত নারীর সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কত নারী যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান
নেই। যুগ যুগ ধরে এ যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। আজ যৌতুক নামক এ কু-প্রথাটি ক্রমান্বয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে।
আজ প্রায় প্রতিটি ছেলে পরিবারের অভিভাবকরা প্রতিযোগিতায় লেগে যায় কে কত বেশি যৌতুক আনতে পারে। এই সমাজে যে যত ভাল পাত্র সে তত বেশি যৌতুকের দাবিদার। যৌতুকের ফলে বিয়ের যোগ্য কন্যার সব দোষ ত্রুটি ঢেকে যায়। যার ফলে অনেক ভাল ছেলে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা যখন যৌতুকের মাধ্যমে বিয়ে করে তখন একথাটি চিন্তা করে না যে, আজ আমি যৌতুক নিয়ে বিয়ে করছি, একদিনতো আমার কন্যাকে বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক দিতে হবে।
আগে যৌতুক হিসেবে উপটৌকন নেয়া হতো রেডিও, চার্জ লাইট, লেপ-তোষক, ঘড়ি, গরু-বাছুর, নগদ ১/২ হাজার টাকা ইত্যাদি। যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে রঙিন টেলিভিশন, মোবাইল, খাট, পালঙ্ক, ৫০/৬০ হাজার টাকা দাবি উঠে। কিন্তু বর্তমানে যৌতুক প্রথা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা আজ আর ঐ সনাতন দাবি দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন যৌতুক হিসেবে চাওয়া হয় গাড়ী, বাড়ি, ৫/১০ লক্ষ নগদ টাকা, স্বাণালঙ্কার, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশন, সরকারী/বেসরকারী চাকুরী, উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গমনের খরচ, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য শ্রমিক ঘাটতি দেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য গ্রামাঞ্চলের বেকার ছেলেদেরকে বিদেশ পাঠানোর খরচসহ নানাবিধ দাবি দাওয়া। ছেলে পক্ষের এই দাবী মিটাতে গিয়ে কন্যা দায়গ্রস্থ পিতাকে অনেক টাকা দিতে হয়।
অনেক কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে দেখছি তার কন্যাকে বিয়ে দেয়ার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের হাত পাততে। এর চেয়ে লজ্জা একজন পিতার জন্য আর কি হতে পারে। এত কষ্ট, ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করেও একজন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা তার কন্যাকে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। কন্যার শশুর বাড়ি থেকে পুন: পুন: চাপ আসতে থাকে নতুন বাজেট পাস করার জন্য। বাপের বাড়ির লোকজন যদি নতুন বাজেট অনুমোদন করে তাহলে বউ খুব ভাল, লক্ষ্মী। আর যদি বাজেট অনুমোদন করতে দেড়ী হয় বা পাস না হয় তাহলে শুরু হয় নির্যাতন। বধুর প্রতিটি কথা স্বামী, শশুর-শাশুড়ির নিকট তেতো লাগে। এক সময় শুরু হয় ঐ অসহায় নারীটির প্রতি শারীরিক, মানসিক নির্যাতন। নির্যাতনের স্টিমরোলার এতই বর্বরোচিত ও নির্মম যে তা মুখে আনাও দুষ্কর। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, লাঠি দিয়ে আঘাত, এসিড নিক্ষেপ, ছুরিকাঘাত ইত্যাদি। তারপর নির্মমভাবে শ্বাসরোদ্ধ করে হত্যা। হত্যার পর ছুরি বা ব্লেট দিয়ে যৌনাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত করা, খুনের পর সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এমন খবরও সংবাদ পত্রের পাতায় উঠে আসে। এ ব্যাপারে যদি কন্যা পক্ষ থানায় মামলা করে তা নেয়া হয় না। কারণ ইতিমধ্যে থানা কর্তৃপক্ষের সাথে খুনীদের সমঝোতা হয়ে যায়। আর যদি মামলা নেয়া হয় তাহলে কন্যা পক্ষকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য জীবনাশের হুমকি দেয়া হয়।
যৌতুক প্রথা নারীকে নগন্য পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে একথা আমরা অনেকেই বলি। কিন্তু আমি মনে করি এই যৌতুক প্রথায় নারী শুধু পণ্য নয় এর চেয়েও নিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। কারণ আমরা যখন বাজারে কোন পণ্য বিক্রি করি তখন টাকার বিনিময়ে বিক্রি করি। কিন্তু নারী নামক বর্তমান পণ্যটি বিয়ে নামক বাজারে পাত্র নামক ক্রেতার কাছে যখন বিক্রি করি তখন সাধারণ পণ্যের মত বিনিময়তো কিছুই পায় না বরং অভিভাবক নামক বিক্রেতাকে যৌতুক হিসেবে কিছু দিতে হয়। যাকে আমরা পণপ্রথা হিসেবে জানি।
এ মুহূর্তে আমার একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটি হল এরূপ। এক বোকা লোক কিছু কলা বাজারে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কলাগুলো এতই ওজন ছিল যে ঐ বোকা লোকটির পক্ষে কলাগুলো বহন করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সে মনে মনে ভাবল কলার ছোলাগুলোতো আর মানুষ খাবে না তাহলে অযথা ছোলাগুলো কষ্ট করে বাজারে নেয়ার কি প্রয়োজন? তাই সে ওজন কমাতে কলার ছোলাগুলো রেখে বাজারে নিয়ে আসল। সারাদিন কলা নিয়ে বসে রইল। কেউ তার কলা নেয় না। আশে পাশের বিক্রেতা কলা বিক্রি করে ফেলল। আর তার কলার মধ্যে ধুলাবালি, মশা মাছি বসল। সন্ধ্যা হয়ে গেল। সে আবার ভাবল এত কষ্ট করে কলাগুলো আনলাম তা আবার কষ্ট করে নিয়ে যাব, তার চেয়ে বরং টাকা দিয়েই কলাগুলো বিক্রি করে ফেলি। তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক টাকা দিয়ে কলাগুলো বিক্রি করতে লাগল। আর তখন ক্রেতারা ভাবল, কলা খেতে না পারি কিন্তু টাকাতো পাব। তাই মুহুর্তের মধ্যে সব কলা বিক্রি হয়ে গেল।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা আশা করি আমার গল্পটি বুঝতে পেরেছেন। সেই কলার মত আজকের নারীরা বেপর্দায় চলাফেরা করে অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়িয়ে অনেক মেয়ে আজ ছোলা কলার মতোই হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে অভিভাবরা তাদেরকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ পিতা কত কষ্ট করে লালন পালন করেছে ঘরে রাখার জন্য নয়। তাই সে কলাওয়ালার মত টাকা দিয়ে দিতে হচ্ছে। আর যৌতুক লোভী পুরুষরা ঐ ক্রেতার মত ভাবে মেয়ে খারাপ হউক তাতে কি আসে যায় যৌতুকতো পাব। এ হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান সমাজের যৌতুক প্রথার জ্বলন্ত উদাহরণ।
যৌতুক প্রথার ফলে আজ নারীর অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। তারা আজ সমাজে মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে না। কাজেই এই মানবতা বিরোধী কুপ্রথা অচিরেই অবসান হওয়া দরকার। তা না হলে এই বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র দেশে কখনও শান্তি আসবে না। নারী যাতে নিগৃহীত, নিপীড়িত না হয় এ জন্য এ হীন যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে এখনই গণআন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার সরকার ও জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ।
দেশে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সরকারকে এ দিকে নজর দেয়া দরকার যাতে কেউ আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে। এই যখন অবস্থা ঠিক তখনই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত ১৯/০৩/২০০৪ইং রোজ শুক্রবার যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের নিকট ১ লক্ষ ১২ হাজারেরও বেশি চিঠি পাঠিয়েছেন। আরও কয়েক লক্ষ চিঠি বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে। গ্রাম সরকার প্রধান হতে শুরু করে সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর নিকটও চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, বাংলাদেশের নারীরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু যৌতুকসহ বিভিন্ন অশুভ সামাজিক প্রথা সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত হবার পথে এখনও প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য যথার্থ। এইতো কিছুদিন আগে আমরা পালন করলাম আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তখনও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন মহল হতে যৌতুকের অভিশাপ থেকে নারী সমাজকে বাঁচাবার কথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি আমরা যারা লেখক, কবি, সাহিত্যিক, পত্রিকার সম্পাদক মসজিদের ইমাম যারা আছি তারা যার যার অবস্থান থেকে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। আর পাত্র-পাত্রীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের সচেতনতা ও ইসলামের আইন কানুন মেনে চলাই এ সমস্যার সমাধন হবে বলে আমি মনে করি।
আধুনিক যুগের শুরুতেই বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ নারী মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। তাদের মত আমাদেরকেও সেই আন্দোলনে শরীক হতে হবে এবং কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হবেÑ ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার গড়িয়েছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ সেই বাণীকে সামনে রেখে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর শরৎচন্দ্র বলেছেন,‘অর্থের বিনিময়ে যারা একজন নারীকে বিয়ে করতে সম্মত হয় সেই পুরুষ কোন দিন তার স্ত্রীকে ভালোবাসবে না।’ কারণ সে তো স্ত্রীকে বিয়ে করেনি করেছে টাকাকে। তাই শরৎ চন্দ্রের ন্যায় আমি বলব, ‘যে পুরুষ অর্থের বিনিময়ে বিয়ে করে সে পুরুষ নয়, সে কাপুরুষ।’
পরিশেষে বলি, যৌতুকের লেনদেনের হীন মানসিকতা পরিবর্তন করে বিবাহযোগ্য নারী পুরুষ ও অভিভাবক সবাই সমস্বরে বলুন, ‘আমরা যৌতুক নেবওনা, যৌতুক দেবওনা।’ আশা করি আমরা সবাই সচেতন হলে যৌতুক প্রথা বন্ধ হবে। আর যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে না পারলে কখনো নারীরা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। ফিরে পাবে না নারীদের হারানো গৌরব। এ জন্য নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ বাড়িয়ে যৌতুক বিরোধী কঠোর আইন প্রয়োগ করে যৌতুককে সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় করতে হবে। তাহলে দেশে আসবে শান্তি, আর পরিবার হবে সুখের।
প্রকাশকাল: বুধবার, ৩১ মার্চ ২০০৪ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন