আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যার ইস্যু, ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার ইস্যু, সাবেক অর্থমন্ত্রী এ.এস.এম কিবরিয়া হত্যার ইস্যুর পর তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের নতুন ইস্যু। এ ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে। পাশাপাশি তারা আরো নতুন ইস্যু খোঁজার চেষ্টায় আছে। দেশের প্রধান বিরোধীদল আওয়ামীলীগ ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার না হলে তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না এবং নির্বাচন হতে দেবে না। আওয়ামীলীগ এ সংস্কারের জন্য প্রস্তাব পেশ করেছে এবং ঘোষণা করেছে এ দাবী মানতে হবে। এ
ঘোষণা দেশের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি একটি হুমকি। তারা বুঝতে পারছে যে, আগামী নির্বাচনে তারা জয়লাভ করতে পারবে না। তাই তারা এ ধরনের ইস্যু তৈরি করছে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, নির্বাচন করলে হার জিত থাকবেই। ভালো কাজ করলে জনগণ ভোট দিবে আর খারাপ কাজ করলে জনগণ ভোট দিবে না এটাই স্বাভাবিক। জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতা দখল করলে জনগণের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। বিনিময়ে ঘৃণা পাওয়া যায়।
চারদলীয় ঐক্য জোটের নেতারা আওয়ামীলীগের এ দাবীকে নাকচ করে দিয়েছে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায় আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আবারও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে চায়। কারণ তাঁর সময়েই আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছিল।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে প্রথম নির্বাচন। সেই নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ছিল। উক্ত নির্বাচনে বিএনপি বিজয় লাভ করে। আওয়ামীলীগ মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে কিন্তু তাদের সে আশা আর পূরণ হয়নি। তাই তারা নির্বাচনকে সূক্ষè কারচুপির অভিযোগ আনল। এ নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ১৮টি আসন। জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করলো। আর আওয়ামীলীগ তখন বিরোধী দলের মর্যাদা পেল। বিএনপির এ বিজয় আওয়ামীলীগ মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা সংসদ বর্জন করে আন্দোলন শুরু করল। এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করতে হবে এ দাবীতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন না করলে সংসদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অংশগ্রহণ করেনি। ফলে বিএনপি আবার সরকার গঠন করলো। কিন্তু সে সংসদ বেশীদিন টিকেনি। আর্ন্তজাতিকভাবে চাপের মাঝে পড়ে বিএনপি। একসময় তাদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ সংবিধানে এয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
১৯৯৬ সালে ১২ জুন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিএনপির আব্দুর রহমান বিশ্বাস। বিএনপির প্রেসিডেন্টের অধীনে নির্বাচন তখন আওয়ামীলীগের কোন আপত্তি ছিল না। সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয় লাভ করে। সুতরাং এ নির্বাচনে সুষ্ঠুতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন আভিযোগ তুলেনি।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতা পেয়ে আওয়ামীলীগ দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। বিএনপির ভুলের কারণে সেইদিন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় বসতে পারে। ক্ষমতা পেয়েই একের পর এক হত্যা ও দলীয় ক্যাডার তৈরি করতে থাকে। ওদের দুঃশাসনে দেশের মানুষ অতিষ্ঠিত হয়ে উঠে। তাদের তৈরি এমপি, মন্ত্রীদের হাতে নির্যাতিত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, ডাঃ ইকবালের মত ক্যাডাররা রাজপথে মানুষ খুন করত। বায়তুল মোকারম মসজিদে হামলা চালিয়ে কি তান্ডবলীলা করেছিল তা দেশবাসী জানে। এসব অনাচার দেখে আওয়ামীলীগকে ঠেকানোর জন্য বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপিকে নিয়ে জোট গঠন করে। পাঁচ বছর শেষ হওয়ার পর ২০০১ সালে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসে। আওয়ামীলীগের পছন্দমত বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট ছিলেন আওয়ামীলীগের তৈরি শাহাবুদ্দিন আহাম্মদ। আর নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এম.এ সাঈদ।
১ আক্টোবর আওয়ামীলীগের মনোনিত সবাইকে মেনে নিয়ে বিএনপি জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ভোটের পর শেখ হাসিনা নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় নিজের কৃতিত্বও দাবি করেন। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই যখন দেখতে পেলেন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়েছে আর আওয়ামীলীগ শোচনীয় পরাজয়বরণ করেছে তখন তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। গতকাল কি বলেছেন তাও তিনি ভুলে গেলেন। এবার তিনি নির্বাচনে স্থুল কারচুপির অভিযোগ আনলেন। নির্বাচন বাতিল করার জন্য দাবি জানালেন। শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করলেন। পরে অবশ্য শপথ গ্রহণ করলেও সংসদ বর্জন করতে লাগলেন। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য দোষারোপ করলেন তাদের মনোনীত প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দীন আহাম্মদ, প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনারকে।
আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে সংসদ নির্বাচন চালু করার জন্য কৃতিত্ব জাহির করে থাকে। তাহলে তারাই আবার কেন এ নির্বাচনের সংশোধন চাচ্ছে? আওয়ামীলীগ কি এর জবাব দিবে। আওয়ামীলীগ ঘোষণা দিয়েছে তত্ত্ববধায়ক সরকারের সংস্কার না করলে ৯৬ সনের মতো এ সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেবে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের সংস্কারের পাশাপাশি আওয়ামীলীগ দাবী করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেও পদত্যাগ করতে হবে। কারণ দলীয় প্রেসিডেন্টের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এখন আমার প্রশ্ন তাহলে ১৯৯৬ সালে বিএনপির দলীয় প্রেসিডেন্টের অধীনে নির্বাচন স্ষ্ঠুু হলো কিভাবে? তাহলে কি ধরে নিব নির্বাচনে জিতলে সুষ্ঠু আর হারলে ‘সুক্ষ’è ও ‘স্থুল’ কারচুপি হয়। ক্ষমতাসীন সরকার পদত্যাগ করবে তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কিন্তু প্রেসিডেন্ট সংসদ ভাঙ্গার সাথে সাথে তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই কেন পদত্যাগ করবে? আর এমন কিইবা তত্ত্ববধায়ক সরকারের দোষ ত্রুটি আছে যার জন্য এ সরকারের সংস্কার করতে হবে? যদি দোষত্রুটি থেকেই থাকে তাহলে এর জন্য আওয়ামীলীগই দায়ী। কারণ তাদের ভাষ্যমতে তারাই তত্ত্ববধায়ক সরকারের জন্মদাতা দাবিদার। আওয়ামীলীগ বুঝতে পারছে তারা আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারবে না তাই নির্বাচন বানচাল করার জন্য তত্ত্ববধায়ক সরকার সংস্কারের ইস্যু নিয়ে অযথা রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করছে। তাই জোট সরকারকে এখন এ ধরনের স্বার্থবাদী দলকে শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে। যাতে তারা আর নতুন কোন ইস্যু তৈরি করতে না পারে।
প্রকাশকাল: বুধবার, ২৫ মে ২০০৫ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন