শুক্রবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

রহস্যময় পুকুর ও বটগাছ

  
জুনায়েদদের বাড়ীর পাশেই ছিল পুরানো একটি পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিল বিশাল একটি বড় বট গাছ। বট গাছটির ডালপালা এতই বিশাল ছিল যে সবগুলো ডালপালাই পুকুরে গিয়ে পড়েছে। বট গাছের ডালপালার কারণে সূর্যের আলো কমই পড়ত পুকুরে। সারাদিনই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব থাকতো এই পুকুরে ।
এখন এই জায়গাটা এতই ভূতুরে হয়েছে যে দিনের বেলাও এখান দিয়ে মানুষজন যেতে ভয় পায়। আর সন্ধ্যার পরতো এখান দিয়ে লোকজন একেবারেই যায় না। প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে কোন না কোন লোক ভয়ের শিকার হয়। এই পুকুরে এক সময় মাছ চাষ করতো কিন্তু এখন আর কেউ মাছ চাষ করে না। ইতোমধ্যে এই পুকুরকে নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কোন ঘটনারই কোন সমাধান এই এলাকার মানুষ দিতে পারেনি। সবার কাছে এই পুকর ও বটগাছটি রহস্যময় হয়ে রয়ে গেল।
আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। জুনায়েদের বয়স তখন দশ বছর। তখন বট গাছটা এত বড় ছিল না। তার ডালপালাগুলো আরো ছোট ছিল। কিন্তু বটগাছের শিকরগুলো পুকুরেই গিয়ে পড়েছে। এই পুকুরটা ছিল জুনায়েদদের বাড়ী থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে। অনেকেই দিনের বেলা তখন এই পুকুরে মাছ ধরত। সেই মোতাবেক জুনায়েদ কোন এক বিকাল বেলা তার চাচাতো ভাই মিলনের সাথে এই পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গেল। দুজনে অনেক্ষণ মাছ ধরল। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
জুনায়েদ বলল, চল মিলন এবার চলে যাই।
মিলন বলল, তুই যা আমি একটু পরে আসতেছি।
ঠিক আছে বলেই জুনায়েদ চলে আসল।
বাসায় এসে যথারীতি পড়তে লাগল।
এদিকে এশার আযান হয়ে গেল। এখনও মিলন বাসায় ফিরেনি। মিলনের মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। সেতো এতক্ষণ বাহিরে থাকে না। সেই বিকাল বেলা মাছ ধরতে পুকুরে গেল জুনায়েদের সাথে। মিলনের মা জুনায়েদের সাথে দেখা করে বলল, জুনায়েদ তোমার সাথেতো মিলন মাছ ধরতে গেল। সেতো এখনও আসে নাই। সে কোথায় তুমি জান?
জুনায়েদ আশ্চার্য হয়ে বলল, কি বলেন কাকী! জুনায়েদ এখনও ফিরে নাই। আমি আর সেতো এক সাথেই মাছ ধরছি। সেতো বলল, একটু পরে চলে আসবে তাই আমি চলে আসলাম। চলেনতো দেখি তাকে দেখে আসি। বাড়ীর সবাই কুপি হাতে নিয়ে ঐ পুকুর পাড়ে চলে আসল মিলনকে খুজার জন্য। জুনায়েদের দেখানো মতে মিলন যে জায়গায় বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল সেই জায়গায় কুপি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই কুপিটি নিবে যায়। তাই তাকে খুজে পাওয়া যায়নি। আবার কুপি ধরিয়ে ঐ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু এবারও কুপিটি নিভে যাচ্ছে। এভাবে আট থেকে দশ বার চেষ্টা করেও ঐ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। সবাই মিলন মিলন বলে ডাকছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। পরিশেষে আশে পাশে সব জায়গায় খোঁজাখুজি করে মিলনকে কোথাও না পেয়ে নিরাশ হয়ে সবাই বাড়ীতে ফিরে আসল। মসজিদের মাইক দিয়ে মাইকিং করে দেয়া হল মিলন নামের দশ/এগার বছরের একটি ছেলে হারানো গিয়েছে। কেউ পেয়ে থাকলে তাকে বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
সারারাত গেল। সকাল হলো। বাড়ীতে কান্নার রুল পড়ে গেল। মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দল বেধে সবাই ঐ পুকুর পাড়ে গেল। এবার পুকুরের ঐ বটগাছের গোড়ায় গিয়ে সবাই আতকে উঠল। একি দেখছে তারা! বটগাছের শিকড়ের নিচে মিলনের মাথা পড়ে আছে। বটগাছের শিকড়টা ছিল পানির মধ্যে। সেই মোতাবেক তার মাথাটা পানির মধ্যেই ডুবানো ছিল। আর তার পুরো দেহ কোথায় খুঁেজ পাচ্ছে না। মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেল পুকুরের পানি। তারপর গ্রামের কয়েকজন মিলে মিলনের মাথাটা পানি থেকে উঠাল। মাথা উঠিয়ে দেখল চোখগুলো উপড়ানো। নাকে মুখে ভয়ংকর কামড়ের দাগ। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয় এসে গেল। এবার সবাই ভাবতে লাগল তার দেহ কোথায় থাকতে পারে। যেহেতু এখানেই তার মাথা পাওয়া গেছে। দেহও এখানেই পাওয়া যাবে। পুকুরে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সবার মাঝে কেমন একটা ভয় কাজ করছে তাই কেউ পুকুরে নামতে রাজি হয়নি। পরে জাল ফেলে খুঁজার সিদ্ধান্ত হলো। বিভিন্ন পাড় থেকে একের পর এক জাল ফেলতে লাগলো পুকুরে। প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টার পরে এক সময় কিছু হাড্ডি উঠে আসে জালে। কিন্তু মিলনের দেহ কোথাও খুঁেজ পাওয়া গেল না। মিলনের দেহের কোন হদিস না পেয়ে পরিশেষে সবাই বুঝে নিল এটা হয়তো মাছে খেয়ে নিয়েছে। তাই হাড্ডি পাওয়া গিয়েছে। কারণ এই পুকুরে এক সময় মাগুর মাছ চাষ করা হতো। সেই মাছগুলোর মধ্যে হয়তো কিছু পুরানো ভয়ংকর মাছ এখনও আছে সেই মাছগুলো হয়তো খেয়ে ফেলছে। অনেক চেষ্টা করেও মিলনের দেহ খুঁেজ না পেয়ে সেই হাড্ডি ও মাথা কাফন করে কবর দেয়া হল।
মিলনের মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। মিলনের মা ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করল।
হঠাৎ মিলনের মায়ের ঘুম ভাঙ্গল। এতো রাতে কে আসবে। তাই মনে ভয় এসে গেল। স্বামীকে ডাকবে কিনা ভাবছে। এমন সময় আবার নক করল। এবার মিলনের মা বলল, কে?
বাহির থেকে আওয়াজ এল মা, আমি মিলন। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমি ভাত খাব।
এ কথা শুনে মিলনের মা আতকে উঠল। মিলন! তুই কোথা থেকে এলি বাবা?
মিলনের মায়ের কথা শুনে তার স্বামী ঘুম থেকে উঠে গেল। কি হয়েছে? তুমি কার সাথে কথা বলছ?
মিলনের সাথে।
মিলনের সাথে! সে আবার কোথা থেকে আসবে। সেতো মরে গেছে।
সত্যি বলছি আমার ছেলে আমাকে ডাক দিয়েছে দরজা খোলার জন্য। ছেলের খুব ক্ষিধে ভাত খাবে।
তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি? মরা মানুষ আবার ডাক দিতে পারে নাকি?
না আমি পাগল হয়নি। আমি স্পষ্ট শুনলাম মিলন আমাকে ডাক দিল। তুমি দরজা খুল। দেখ মিলন দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে।
না তুমি ভুল শুনছ।
আমি ভুল শুনিনি। আমি দরজা খুলে দেখব।
না তুমি এত রাতে দরজা খুলবে না।
না আমি দরজা খুলবই।
দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তর্কাতর্কি। মিলনের মা তার স্বামীকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে মিলন তাকে ডাক দিয়েছে। তাই জোরাজোরির এক পর্যায়ে স্বামীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মিলনের মা দরজা খুলল। দরজা খুলেই দেখতে পেল কাপনের কাপড় পড়া অবস্থায় শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভয়ংকর লোক। চোখগুলো থেকে রক্ত ঝরছে। এ দৃশ্য দেখে মিলনের মা ভয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তার স্বামী পিছনে পিছনে আসল কিন্তু এসসব কিছুই দেখল না। তারপর বাড়ীর আশে পাশের লোকজন চলে আসে। মিলনের মাকে পানি দিল। ঝারফুক করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সকাল বেলা জ্ঞান ফিরল ঠিকই কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় আর তাকে পাওয়া যায়নি। অর্থ্যাৎ সে পাগল হয়ে গেছে। সে এখন মিলন মিলন বলে চিৎকার করছে। দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত পাগল অবস্থায় আজও মিলনকে খুজে বেড়ায় সেই পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। কখনো রাতের অন্ধকারে একা একা ছুটে চলে যায় পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। আজও সেই মিলনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি গ্রামবাসী। তার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে রহস্যময় এই পুকুর পাড়ে।
গত দু বছর পূর্বেও ঘটে গেল এই পুকুরের পাড়ে বটগাছে এক ঘটনা। কোথা থেকে এক মহিলা এখানে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সকাল বেলা লোকজন এসে দেখে ঐ মহিলা জিহ্বা বের করে রশিতে ঝুলে আছে। কেউ ভয়ে এ মহিলার লাশ ছুতে যায়নি। এমনকি কারো সাহস হচ্ছে না তার লাশ নামাতে। গ্রামবাসী এলাকার মেম্বার ও চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। তারা এসে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে এ লাশ নিয়ে যায়। সেই থেকে এখানে আরো আতঙ্ক বেড়ে যায়।
এক সময় গ্রামবাসীরা সবাই মিলে এই পুকুর ভরাট ও বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যেদিন রাতে এ সিদ্ধান্ত নেই সেদিন রাতেই সবাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে, কেউ যদি এই পুকুর ও বটগাছ ধ্বংস করতে চায় তাহলে তার বংশ ধ্বংশ করে হয়ে যাবে। তাই আর কেউ সাহস করে বটগাছ কাটতে যায় না। পুকুর মাটি দিয়ে ভরাট করতে যায় না।
কিছুদিন পূর্বে জুনায়েদ চাকরী পায় পার্শ্ববর্তী এক শোয়েটার ফেক্টরীতে। প্রথম সপ্তাহ দিনের বেলা ডিউটি পড়ে। প্রতিদিন সকাল ৬ টায় যেত ফিরত দুপুর দুটো। প্রতি সপ্তাহে ডিউটি পরিবর্তন হওয়ায় আজ তার ডিউটি হলো দুপুর দুটো থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। যথারীতি প্রতিদিনের মতো আজও ডিউটিতে আসল। ছুটি হলো রাত ১০:০০ টায়। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বের হতে সময় লাগল আরো আধা ঘন্টা। অর্থ্যাৎ রাত সাড়ে দশটার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বেশী রাত্র হওয়ায় রাস্তায় কোন রিক্সা নেই। আশে পাশে কোন লোকজনও নেই। তাদের বাড়ী থেকে শোয়েটার ফেক্টরীটা প্রায় দুই কিলোমিটা দূরে। পুরো রাস্তায় হেটে আসতে হয়। তাদের গ্রাম থেকে একমাত্র সেই এখানে চাকরী করে। তাই তার কোন সঙ্গী নেই। একা একা এত রাতে বাড়ী ফিরতে তার কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। কিছুটা ভয় কাজ করছে তার মনে। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সেই পুকুর পাড়ের বটগাছের কাছাকাছি চলে আসল। তখন বাজে প্রায় রাত সাড়ে এগারটা। শোয়েটার ফেক্টরী থেকে জুনায়েদদের বাড়ীতে যাওয়ার এই একমাত্র একটি রাস্তা। এর কোন বিকল্প রাস্তা নেই। এই বটগাছ ও পুকুর কসিং করেই তাদের বাড়ীতে আসতে হয়। এছাড়া কোন উপায় নেই। বটগাছের কাছাকাছি আসতেই তার পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আর অমনি তার মধ্যে ভয় কাজ করছে। সে যতই সামনে আসছে ততই ভয় পাচ্ছে। বটগাছের কাছাকাছি এসেই দেখতে পেল চারজন লোক বসে একটি লাশ কামড়িয়ে খাচ্ছে। আর একজন চোখ বড় বড় করে বলছে, এই ছেলে এদিকে আসবি না। তোকেও খেয়ে ফেলব।
এ দৃশ্য দেখে জুনায়েদ চিৎকার দিয়ে দৌঁড় দিল। এক দৌঁড়ে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে গেল। বাড়ীর আশে পাশের লোকজন তার চিৎকার শুনে চলে আসল। সবার কাছে জুনায়েদ ঘটনাটি বর্ণনা করল। সবাই বিশ্বাস করলেও কেউ সাহস করে সত্যতা যাচাই করার জন্য যায়নি।
পরদিন সকাল বেলা প্রতিবেশীরা জুনায়েদের সেই ঘটনা দেখার জন্য দলবেধে সেই বটগাছের নিচে গেল কিন্তু এ ধরনের কোন আলামতই দেখতে পেল না। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কিন্তু এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি কেউ।

রচনাকাল: ২৩/০১/২০১৫খ্রি:
নক্ষত্রব্লগ কর্তৃক সৃজনশীল ব্লগিং প্রতিযোগিতা-২০১৫ এর পুরস্কার প্রাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই: