শুক্রবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সংবাদপত্রের ভূমিকা, গুরুত্ব ও স্বাধীনতা




বর্তমান সভ্য ও নগর সমাজের অপরিহার্য সঙ্গী হচ্ছে সংবাদপত্র। গণমাধ্যমের প্রধান বাহন হিসেবে মানুষের মধ্যে এর গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংবাদপত্রের গমন, বিচরণ এবং পরিধিও বাড়ছে। মানুষ যত শিক্ষিত এবং সচেতন হচ্ছে ততই সংবাদপত্রের ব্যবহার বাড়ছে। সংবাদপত্রের বিচরণ ক্ষেত্র ক্রমশ নগর থেকে শহর, শহর থেকে উপশহর, মফস্বল শহর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে। সকালের সংবাদপত্র দুপুর, বিকেল, রাত এমনকি একদিন পরে গেলেও মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ে। আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে অন্যান্য দেশে সংবাদপত্র পড়ার জনসংখ্যার হার অনেক বেশী। সুতরাং বলা যায়, দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে সংবাদপত্র। এটি গণমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী বাহন।

কারণ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই গোটা বিশ্বের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। সংবাদপত্র পুরো পৃথিবীটাকেই আমাদের ঘরের এবং মনের কাছাকাছি এনে দেয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই আমরা ঘরে বসে গোটা বিশ্বকে অবলোকন করি। এজন্য সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতা অচল। সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের দর্পণ। প্রতিদিন সমাজে যা কিছু ঘটে তাই পত্রিকার পাতায় সাজানো হয়। তাই বলা যায়, সমাজের মানুষের নিজেদের খবর, প্রাত্যহিক ঘটনাবলী প্রভৃতি সর্ম্পকে ধারণা অর্জন করতে ছুটে যায় পত্রিকার পাতায়। মানুষ তাদের নিজেদের সমাজের ঘটনা সংবাদপত্রের পাতায় দেখে চমকৃত হয়, সচেতন হয় ও শিক্ষা নেয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক খবরসহ জাতীয়, আঞ্চলিক, আর্ন্তজাতিক নানাবিধ তথ্য খবরাখবর মানুষ সংবাদপত্র থেকে সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া সংবাদপত্রের বিরাট অংশ জুড়ে থাকে বিজ্ঞাপন। এটিও মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চাকরি, ক্রয়-বিক্রয়, পড়াতে চাই, পাত্র-পাত্রী চাই, হারানো বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি অসংখ্য বিজ্ঞাপন আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থারই প্রতিচ্ছবি।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আঝে, “A newspaper is a store house of knowledge.’’ অর্থা সংবাদপত্র হচ্ছে জ্ঞানের ভান্ডার। রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা থেকে শুরু করে বিদ্রোহ, বিপ্লব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র সব কিছুই এর আওতায় পড়ে। কোথায় কোন মন্ত্রীসভা পুর্নগঠিত হলো, নতুন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কে শপথ নিলেন, কোথায় কে বিশ্ব বিখ্যাত হলেন, কোন পবর্তচূড়ায় কোন অভিযাত্রীর পদচিহ্ন অংকিত হল, কোথায় কোন নেতা মৃত্যুবরণ করল, কোথায় কোন গহীন অরণ্যে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল সংবাদপত্র সবই আমাদেরকে অবহিত করে। তাছাড়া খেলাধূলা, আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, আমোদ-প্রমোদ, শেয়ার মাকের্ট, বাজারদর, কর্মখালী, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি সবকিছু সংবাদপত্র আমাদের সামনে উপস্থিত করে।
সমাজে সংবাদপত্রের প্রভাব অসামান্য। একটি পত্রিকা একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে। হতে পারে একটি আন্দোলন। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, অন্যায় অপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, নারী বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদপত্র জনগণকে সচেতন করে তুলে। একটি পত্রিকা একটি শক্তিশালী আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। পত্রিকার বিপুল সংখক পাঠক ও আদর্শের অনুসারী হতে পারে। বর্তমান বিশ্বের সকল শ্রেণীর লোকের নিকট সংবাদপত্র পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতগুলো মাধ্যম আছে তার মধ্যে সংবাদপত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ। সংবাদ শিক্ষিত মানুষের নিকট আহার নিদ্রার মতোই প্রয়োজনীয়। সংবাপত্র পাঠ না করলে মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা পরিপূর্ণ হতে পারে না। পুস্তকের শিক্ষা অপর্যাপ্ত ও সীমাবদ্ধ আর সংবাদপত্রের শিক্ষা পরিপূর্ণ, বিচিত্র ও নিত্য নতুন। সংবাদপত্র পাঠ ছাড়া বর্তমান বিশ্বের সব খবরাখবর জানার কোন উপায় নেই।
বর্তমানে আমাদের দেশে সংবাদপত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক সময় সরকারি নিয়ন্ত্রণ কিংবা তথাকথিত গডফাদারদের হুমকি, সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আবার অনেক পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে। কোন কোন পত্রিকা বিশেষ কোন দল, আদর্শ কিংবা রাজনীতিকে সমর্থন করে কিংবা সরকারের তোষামোদী করে। ফলে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে তাদের  পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা স্বেচ্ছায় বস্তুনিষ্ঠতা এড়িয়ে যায়। কিন্তু সংবাদপত্রের মূল আদর্শ হওয়া উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন। সংবাদপত্র হতে হবে জনসাধারণের অতন্দ্র প্রহরী। জনগণের স্বার্থে সংবাদপত্র যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, তেমনি ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যও করবে সংগ্রাম। ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ কামনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশের মত একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আশানুরূপ নয়। এখানে ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারই স্বীয় দলীয় স্বার্থে সংবাদপত্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্ঠায় লিপ্ত থেকে বার বার সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর তকালীন আওয়ামীলীগ সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে যেভাবে হরণ করে তার পুনরাবৃত্তি ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরচারী এরশাদ সরকারের আমলেও হয়। যে কোন ব্যাপারেই পত্রিকার ঘোষণাপত্র বাতিল করার মত নিন্দনীয় আইন এখনও আমাদের দেশে বলব আছে। বর্তমান সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। গত পাঁচ বছরে বর্তমান সরকার বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের স্কাইপি ক্যালেঙ্কারি ফাঁস করে বন্ধ হল আমারদেশ পত্রিকা, হেফাজতের উপর বর্বরোচিত গণহত্যার ক্যালেঙ্কারি ফাঁস করে বন্ধ হলো দিগন্ত ও ইসলামী টেলিভিশন। সাতক্ষীলায় ভারতীয় বাহিনীর তান্ডবের ফ্যাক্স ক্যালেঙ্কারি ফাঁস করে বন্ধ হল ইনকিলাব। যা জাতির জন্য শুভকর নয়। তাই অচিরেই সংবাদপত্রকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া দরকার। এজন্য সরকারের উদার ও সহিষ্ণু নীতি থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও সংবাদপত্রের প্রকাশকদের আন্তরিক হতে হবে। ফলে সংবাদপত্র হয়ে উঠবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের বাহন।

লেখক- উপন্যাসিক, কলামিষ্ট।
১৯/০১/২০১৪ খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই: