পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। এ দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন উৎসব। সারা বিশ্বে বাঙালিরা এ দিনটিকে নতুন বছর হিসেবে বরণ করে নেয়।
ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের সব দুঃখ-গ্লানি। সকলের একটাই কামনা থাকে নতুন বছরটি যেন সুখ সমৃদ্ধ হয়। ব্যবসায়ীরা এদিনটিকে ব্যবসা শুরুর নতুন উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। এদিনে তারা শুভ হালখাতার আয়োজন করে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ দিন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
আমাদের দেশে বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলা বসে। বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানে মেলা বসে। বাড়িতে বাড়িতে চলে বিশেষ খাবারের আয়োজন। প্রচলিত আছে এ দিন ভাল খাবার খেলে সারা বছর ভাল খাওয়া যায়। যা একটি কু-সংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকে আবার বৈশাখের সকালে পান্তা ভাত খায়। চৈত্রের ৩০ তারিখ রাতে রান্না করে বৈশাখের প্রথম দিন সকালে খাওয়াটা বাঙালির ঐতিহ্য বলে দাবি করে। এক বছরের ভাত অন্য বছরে খেয়ে তারা তৃপ্তি পায়। আরো অনেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা এ ঐতিহ্যবাহী দিনটি অতিবাহিত করি। এ যেন ঈদের আনন্দের চেয়েও কম নয়। এখানে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ গ্রহণ করে। বর্তমানে বাংলা সন আমাদের জাতীয় জীবনে যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। কয়েকটি গ্রাম মিলে কোন খেলার মাঠে বা ঐহিত্যবাহী বটগাছের নিচে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন। থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মেলা প্রাঙ্গনে সন্ধ্যার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও কোথাও গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, হা-ডু-ডু, ঘোড়া দৌড়, কুস্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশে কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানে। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে ব্যাপক পরিচিত।
পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান জানানো হয়। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনার বটমূলে সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের করা হয়। এটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন অলি-গলিতে প্রদক্ষিণ করে। এই শোভা যাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই শোভাযাত্রায় দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ নানান সাজে অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রঙ বেঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। এই শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের একটি অন্যতম আকর্ষণ। এই শোভাযাত্রা দেশের সকল জেলা থেকে বের হয়।
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা বিভিন্ন রূপে বর্ষবরণ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই বছরের নতুন দিনে উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরারের বেশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে থাকে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। এই উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি উৎসব হলো মার্মাদের পানি উৎসব।
পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়। সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়ক পূজা। এই দিনে সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়াও বহু পরিবার বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সর্ম্পকের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী পালন করে। পরের দিন পহেলা বৈশাখ প্রতিটি পরিবার স্নান সেরে বয়:জ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি প্রচলিত।
আমরা যে এত আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করি, কিন্তু এ দিনটি বা বাংলা সন আমাদের মাঝে কিভাবে এলো তার রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস ও হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, ঊড়িষা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। ১৫৫৬ সালে বাদশা আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জীতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। সেই থেকে বাংলা সনের সূচনা। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময়(৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ভারত বর্ষে ভারত সন, লক্ষণ সন, শকাব্দ সন, বিক্রম সন, জালালী সন, সেকান্দর সন, গুপ্তাব্দ সন প্রচলিত ছিল। তখন এগুলো চন্দ্র রীতিতে গণনা করা হতো। যার ফলে সৌর বছরের সাথে এসব সালের গোলমাল হয়ে যেত প্রতি বছর। চন্দ্র উদয়ের সাথে হিসেব করে চন্দ্র সনের মাস গণনা করা হয়ে থাকে। প্রতি চন্দ্র মাসের ২৯/৩০ দিনে চাঁদ উদয় হলে নতুন মাস শুরু হত। এভাবে প্রতি বছর অন্তর অন্তর চন্দ্রবর্ষে একমাস অতিরিক্ত যোগ করে সৌর বর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হতো। আর এই অতিরিক্ত মাসটিকে জ্যোতিষিরা বলতো ‘মিল মাস’। এই অদ্ভুত হিসেবের ফলে প্রজা সাধারণ অসুবিধায় পড়তো। তখন এ অসুবিধা দূর করার জন্যই আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস সৌর মাসে রূপান্তরিত করেন। আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তনের ফলে বাংলা সনের তারিখ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তখন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরো অনেক মনীষী, প-িতের প্রচেষ্টার ফল হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৮ সালে তা সরকারিভাবে কার্যকর করে। আর বর্তমানে সরকারি নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদির তারিখ নির্ধারণে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্র
ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের সব দুঃখ-গ্লানি। সকলের একটাই কামনা থাকে নতুন বছরটি যেন সুখ সমৃদ্ধ হয়। ব্যবসায়ীরা এদিনটিকে ব্যবসা শুরুর নতুন উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। এদিনে তারা শুভ হালখাতার আয়োজন করে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ দিন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
আমাদের দেশে বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলা বসে। বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানে মেলা বসে। বাড়িতে বাড়িতে চলে বিশেষ খাবারের আয়োজন। প্রচলিত আছে এ দিন ভাল খাবার খেলে সারা বছর ভাল খাওয়া যায়। যা একটি কু-সংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকে আবার বৈশাখের সকালে পান্তা ভাত খায়। চৈত্রের ৩০ তারিখ রাতে রান্না করে বৈশাখের প্রথম দিন সকালে খাওয়াটা বাঙালির ঐতিহ্য বলে দাবি করে। এক বছরের ভাত অন্য বছরে খেয়ে তারা তৃপ্তি পায়। আরো অনেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা এ ঐতিহ্যবাহী দিনটি অতিবাহিত করি। এ যেন ঈদের আনন্দের চেয়েও কম নয়। এখানে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ গ্রহণ করে। বর্তমানে বাংলা সন আমাদের জাতীয় জীবনে যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। কয়েকটি গ্রাম মিলে কোন খেলার মাঠে বা ঐহিত্যবাহী বটগাছের নিচে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন। থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মেলা প্রাঙ্গনে সন্ধ্যার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও কোথাও গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, হা-ডু-ডু, ঘোড়া দৌড়, কুস্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশে কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানে। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে ব্যাপক পরিচিত।
পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান জানানো হয়। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনার বটমূলে সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের করা হয়। এটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন অলি-গলিতে প্রদক্ষিণ করে। এই শোভা যাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই শোভাযাত্রায় দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ নানান সাজে অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রঙ বেঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। এই শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের একটি অন্যতম আকর্ষণ। এই শোভাযাত্রা দেশের সকল জেলা থেকে বের হয়।
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা বিভিন্ন রূপে বর্ষবরণ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই বছরের নতুন দিনে উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরারের বেশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে থাকে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। এই উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি উৎসব হলো মার্মাদের পানি উৎসব।
পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়। সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়ক পূজা। এই দিনে সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়াও বহু পরিবার বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সর্ম্পকের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী পালন করে। পরের দিন পহেলা বৈশাখ প্রতিটি পরিবার স্নান সেরে বয়:জ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি প্রচলিত।
আমরা যে এত আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করি, কিন্তু এ দিনটি বা বাংলা সন আমাদের মাঝে কিভাবে এলো তার রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস ও হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, ঊড়িষা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। ১৫৫৬ সালে বাদশা আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জীতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। সেই থেকে বাংলা সনের সূচনা। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময়(৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ভারত বর্ষে ভারত সন, লক্ষণ সন, শকাব্দ সন, বিক্রম সন, জালালী সন, সেকান্দর সন, গুপ্তাব্দ সন প্রচলিত ছিল। তখন এগুলো চন্দ্র রীতিতে গণনা করা হতো। যার ফলে সৌর বছরের সাথে এসব সালের গোলমাল হয়ে যেত প্রতি বছর। চন্দ্র উদয়ের সাথে হিসেব করে চন্দ্র সনের মাস গণনা করা হয়ে থাকে। প্রতি চন্দ্র মাসের ২৯/৩০ দিনে চাঁদ উদয় হলে নতুন মাস শুরু হত। এভাবে প্রতি বছর অন্তর অন্তর চন্দ্রবর্ষে একমাস অতিরিক্ত যোগ করে সৌর বর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হতো। আর এই অতিরিক্ত মাসটিকে জ্যোতিষিরা বলতো ‘মিল মাস’। এই অদ্ভুত হিসেবের ফলে প্রজা সাধারণ অসুবিধায় পড়তো। তখন এ অসুবিধা দূর করার জন্যই আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস সৌর মাসে রূপান্তরিত করেন। আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তনের ফলে বাংলা সনের তারিখ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তখন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরো অনেক মনীষী, প-িতের প্রচেষ্টার ফল হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৮ সালে তা সরকারিভাবে কার্যকর করে। আর বর্তমানে সরকারি নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদির তারিখ নির্ধারণে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন