কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন এক কবিতায়
বলেছিলেন, ‘বিপুল এই পৃথিবীরে কতটুকু জানি’ সত্যিই আল্লাহর দেয়া এই সুন্দর
পৃথিবীকে আমরা কতটুকুইবা জানি।পাহাড়, পর্বত, গাছ-পালা, নদী-নালা,
গ্রহ-তারা, বন-বনানী, আর আদিগন্ত শ্যামলের এই পৃথিবীকে তিনি যেমন অপার
সৌন্দর্যের লীলাভূমি বানিয়েছেন, তেমনি করেছেন রহস্যের এক মায়াবী লোক।
আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের অপরূপ
সৌন্দর্যের সাথে অন্য কোন দেশের তুলনা হয় না। বাংলাদেশের তুলনা বাংলাদেশ
নিজেই। এ যেন সবুজ চাদরে আবৃত একটি দেশ। সুজলা সফলা শস্য শ্যামলা সোনার
বাংলাদেশের অতুল সৌন্দর্যে লাবন্যমন্ডিত একটি জেলার নাম কক্সবাজার পর্যটন
জেলা। দেশী-বিদেশী সকল পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। প্রতি বছর
সমুদ্র সৈকত দেখতে শীত মৌসুমে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। সুদুর আমেরিকা,
ইউরোপ থেকেও পর্যটকরা এখানে আসেন। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫৩ কিলোমিটার। পর্যটকদের নিকট আকর্ষনীয় জায়গাটি মাইলের পর মাইল বালুকাময় সৈকত, ঝিনুক, বৈচিত্র্যময় প্যাগোডা রাখাইন উপজাতিদের অভিনব জীবন যাত্রায় পূর্ণ। ঘন সবুজ পাহাড় ঘেরা এই শহর একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রও বটে। কক্সবাজারের আয়তন ২,৪৯২ কিঃ মিঃ এই কক্সবাজার জেলায় চাষ করা হয় লবণ, তরমুজসহ আরো অনেক কিছু। দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনের কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার। এর মধ্যে চকোরিয়াও পেকুয়া উপজেলায় লবণের চাষ বেশি করা হয়। সনাতন ও পলিথিন দুই পদ্ধতিতেই লবণ চাষ করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ৪২ হাজার একর জমিতে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকোরিয়া, কুতুবদিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পেকুয়া এই ৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার জেলা। এটি নাফ নদী ও মাতামুহূরী নদীর তীরে অবস্থিত। এর পূর্ব নাম ফালকিং। এর ইতিহাস বড়ই চমৎকার। ১৭৯৭ সাল। তখন এই দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকাল। তখন বার্মার আরাকান অঞ্চলে গন্ডগোল দেখা দিলে বাঙালিদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই বিতাড়িত ছিন্নমূল বাঙালিরা তখন বর্তমান কক্সবাজার, উখিয়া এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কক্স নামে একজন দূত বার্মার রাজদরবারে কাজ করতেন। তিনি কোম্পানির নির্দেশে এখানকার শরণার্থীদের তদারকের জন্য কক্সবাজার ছুটে আসেন। তখন এ অঞ্চলে দেখা দেয় মহামারী। মশা, মাছির কামড় ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন দুর্যোগের দিনে ক্যাপ্টেন কক্স শরণার্থীদের ফেলে চলে যাননি বরং তাদের সঙ্গে কাজ করে গেলেন। ১৮০২ সালে ক্যাপ্টেন কক্স মারা যান। তখন তার নামানুসারে ফালকিং এর পরিবর্তে ‘কক্সবাজার’ নামকরণ করা হয়।
ইউরোপ থেকেও পর্যটকরা এখানে আসেন। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫৩ কিলোমিটার। পর্যটকদের নিকট আকর্ষনীয় জায়গাটি মাইলের পর মাইল বালুকাময় সৈকত, ঝিনুক, বৈচিত্র্যময় প্যাগোডা রাখাইন উপজাতিদের অভিনব জীবন যাত্রায় পূর্ণ। ঘন সবুজ পাহাড় ঘেরা এই শহর একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রও বটে। কক্সবাজারের আয়তন ২,৪৯২ কিঃ মিঃ এই কক্সবাজার জেলায় চাষ করা হয় লবণ, তরমুজসহ আরো অনেক কিছু। দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনের কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার। এর মধ্যে চকোরিয়াও পেকুয়া উপজেলায় লবণের চাষ বেশি করা হয়। সনাতন ও পলিথিন দুই পদ্ধতিতেই লবণ চাষ করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ৪২ হাজার একর জমিতে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকোরিয়া, কুতুবদিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পেকুয়া এই ৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার জেলা। এটি নাফ নদী ও মাতামুহূরী নদীর তীরে অবস্থিত। এর পূর্ব নাম ফালকিং। এর ইতিহাস বড়ই চমৎকার। ১৭৯৭ সাল। তখন এই দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকাল। তখন বার্মার আরাকান অঞ্চলে গন্ডগোল দেখা দিলে বাঙালিদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই বিতাড়িত ছিন্নমূল বাঙালিরা তখন বর্তমান কক্সবাজার, উখিয়া এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কক্স নামে একজন দূত বার্মার রাজদরবারে কাজ করতেন। তিনি কোম্পানির নির্দেশে এখানকার শরণার্থীদের তদারকের জন্য কক্সবাজার ছুটে আসেন। তখন এ অঞ্চলে দেখা দেয় মহামারী। মশা, মাছির কামড় ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন দুর্যোগের দিনে ক্যাপ্টেন কক্স শরণার্থীদের ফেলে চলে যাননি বরং তাদের সঙ্গে কাজ করে গেলেন। ১৮০২ সালে ক্যাপ্টেন কক্স মারা যান। তখন তার নামানুসারে ফালকিং এর পরিবর্তে ‘কক্সবাজার’ নামকরণ করা হয়।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম
খালেদা জিয়া নরসিংদী সরকারি কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষাসফরে যাওয়ার
জন্য একটি বাস উপহার দেন। সেই বাসে চড়ে ১৭ নভেম্বর ২০০৫ সাল রাত ১০:৩৫
মিনিটে বিরল সৌন্দর্যের এই জনপদ কক্সবাজারের উদ্দেশ্য নরসিংদী ত্যাগ করছি।
সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে কক্সবাজার, সাফারী পার্ক, টেকনাফ ও বাংলাদেশের শেষ
সীমানা এবং একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যাব। ৫দিনের এই শিক্ষা সফরের
আয়োজন করে নরসিংদী সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। আমরা সকল
শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও স্টাফসহ মোট ৫২ জনের সফর কাফেলা। এর
মধ্যে ২৬ জন ছাত্র, ১৬ ছাত্রী, ২ জন স্টাফ, ৪ জন শিক্ষক। শিক্ষকদের মধ্যে
অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যার ও তাঁর স্ত্রী, সমাজবিজ্ঞান
বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুল মান্নান খাঁন ও তাঁর স্ত্রী, প্রভাষক আবু
ইব্রাহিম মোঃ নুরুল হুদা স্যার ও তাঁর ছেলে অন্তু এবং স্ত্রী ও গেষ্ট টিচার
মোশারফ হোসেন স্যার।
আমাদের বাসটি কাঁচপুর হয়ে ৯৩০ মিঃ লম্বা
মেঘনা গোমতী সেতু পার হয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার দিকে। আর এদিকে
বাসের ভেতর শুরু হয়েছে পাঁচমিশালী গানের আসর। যে যেই গান পারে সে সেই গান
গাইছে। আজ যেন ছাত্র-শিক্ষক কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই যেন আজ বন্ধু। বাসের
ঝাকুনির তালে তালে আমরা নাচে গানে মেতে উঠলাম। শ্যামল ভাই, খাইরুন নাহার,
জুয়েল, মিথুন, সোহেল ভাই ও আকরাম ভাইয়ের গানের সুরের মুর্ছনায় কখন যে বাস
কুমিল্লায় এসে গেল টের পেলাম না।
কিছুক্ষণ পর পাদুয়া বাজার নুরজাহান হোটেলের
সামনে আমাদের বাসটি থামল। তখন রাত ১টা বাজে। নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে
বলে দিলেন ফ্রেশ হয়ে এখানে কিছু খেয়ে নেয়ার জন্য। আমরা সবাই বাস থেকে নেমে
হোটেলে প্রবেশ করলাম। খুবই উন্নতমানের থ্রীস্টার হোটেল। হাত মুখ ধুয়ে আমি ও
আমার বন্ধু নিশিথ এক সাথে বসলাম। এখানে প্রতিটা টেবিলে খাবারের দামসহ মেনু
দেয়া আছে। এই হোটেলের সবচেয়ে সস্তা খাবার হচ্ছে নানরুটি। দু’জনে দুটি
স্পেশাল নান রুটি নিলাম। সাথে ভাজিও নিলাম। বিল হয়েছে ৬০ টাকা। এখানে এক
ঘন্টা ১৫ মিনিট যাত্রা বিরতির পর ২:১৫ মিনিটে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু
করলাম। বাসের ভেরত আবার শুরু হলো গান, কৌতুক, হৈ হুল্লোর। গান গাইতে গাইতে
এক সময় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সবার চোখেই ঘুম আসছে। কেউ ঘুমাচ্ছে আবার
কেউ মৃদু স্বরে গান গাইছে। কিছুক্ষণ পর পর নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে
হ্যান্ড মাইক দিয়ে ডেকে সজাগ করে দিচ্ছে আর মজার মজার কথা বলে হাসাচ্ছেন।
রাত ৩টায় আমাদের বাসটি ফেনীতে পৌঁছে। ভোর ৪টায় সীতাকুন্ডে পৌঁছে। এখানে ৫
মিনিট যাত্রা বিরতীর পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। ৫টায় চট্টগ্রাম আসি। ৫:২০
মিনিটে স্টেশন রোডে হোটেল মিসকাহতে আমরা উঠি। সকালের নাস্তা ও রেস্ট নেয়ার
জন্য এই হোটেল ভাড়া নেয়া হয়। কিন্তু আমরা এসে দেখি এখানে কোন খাবার তৈরি
হয়নি। স্যারদের রাগারাগিতে এক পর্যায়ে তারা রান্নার কাজ শুরু করে। তাড়াহুড়ো
করে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ৬:৩০ মিনিটে আধা কাচা সেদ্ধ তরকারি ও
পাউরুটি এনে দিল। এক দিকে খাবার দিলে অন্য দিকে দিচ্ছে না। নাস্তার পর চা
দিল, চা নয় এ যেন পুকুরের গোলা পানি গরম করে দিল। এভাবে কষ্ট করে কোন মতে
নাস্তা করে এখান থেকে বিদায় নিলাম।
ইতোমধ্যে বাসে আমাদের ১দিন চলে গেল। ১৮
তারিখ ৭:১০ মিনিটে বাসটি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাসটি চট্টগ্রাম
শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর
দিয়ে কর্ণফুলী রেল সেতু পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাসের ভেতর শুরু হয়েছে
প্যারোডি গানের আসর। প্রথমে উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যার চারটি প্যারোডি
গান গাইলেন।
প্রথমটি হলো- ‘মরি হায়রে হায় দুখে পরান যায়, দিবা নিশি জ্বইলা মরি বউয়ের যন্ত্রণায়, মরি হায়রে হায়…।’
দ্বিতীয়টি হলো- ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না…।’
তৃতীয়টি হলো- ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছাইয়া দেরে তুই আল্লাহ…।’
সর্বশেষ গানটি হলো- ‘সোসিওলজি ক্লাসে দেখ…।’
তারপর পর্যায়ক্রমে খাইরুন নাহার, মিথুন,
নিপা, শ্যামল ও আকরাম ভাই গান গাইলেন। পরে আবার মোহাম্মদ আলী স্যার গান
গাইলেন- ‘আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ…।’ ‘নানীগো
নানী আমারে নী লইয়া যাইবা ভাইসাবের বাড়ি…।’ ‘কাউয়া ধান খাইলরে খেদাবার
মানুষ নাই, খাইবার বেলা আছে মানুষ কামের বেলা নাই…।’ এ গানটি যখন স্যার
গাইলেন আমার তখন শিশুকালের কথা মনে পড়ে গেল। একদিন আম্মা ধান রোদে শুকাতে
দেয়। আমাকে কাক তাড়ানোর জন্য বসিয়েছিলেন। তখন আমি এই গানটি গাইছিলাম।
এভাবে স্যার পর পর তিনটি গান গাইলেন।
মুহূমুহূ করতালির মাধ্যমে স্যারকে আরো গান গাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হল।
ইতোমধ্যে আমাদের বাসটি চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় পৌঁছল। আমি জানালা দিয়ে
তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। রাস্তার দু’পাশে সবুজ গ্রাম, সারি সারি তাল
গাছ। নাম না জানা অসংখ্য গাছ, সবুজ ধান ক্ষেত। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বাসটি
দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে কখন কক্সবাজার এসে
পৌঁছব। লোহাগড়া থানায় এসে বাসটি যাত্রা বিরতী নিল।
সকাল ৯:৪০ মিনিটে আমরা কক্সবাজার জেলায়
প্রবেশ করি। চকোরিয়া হয়ে বাসটি এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট সবুজ
পাহাড়, আকাশি, শিশু, মেহগনি, ঝাউগাছসহ নানা প্রকার গাছে পাহাড় ভরপুর।
পাহাড়ের উপর ছোট ছোট কুড়েঘর। এসব দৃশ্য আমি মুগ্ধ নয়নে দাঁড়িয়ে দেখছি।
আঁকাবাকা, উচ-নিচু রাস্তা পার হয়ে বাসটি শো শো আওয়াজ করে সমুদ্র সৈকতের
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১০:৫৫ মিনিটে বাসটি হঠাৎ হোটেল ‘অবকাশ’ এর সামনে থেমে
গেল। তখন বুঝতে পারলাম আমরা কক্সবাজার এসে গেছি। বামদিকে তাকিয়ে আমরা
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত দেখতে পেলাম। তখন আমরা সবাই বসা থেকে উঠে
দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সাগরকে স্বাগতম জানালাম। এখান থেকেই আমরা সাগরের গর্জন
শুনতে পেলাম।
নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে বললেন এখন রূমে
গিয়ে রেস্ট নেয়ার জন্য। বিকেল ৪:৩০ মিনিটে সী-বীচে যাবে। বাস থেকে নেমে
আমি, হাফিজ, জুবায়ের ও নিশিথ এই চারজন এক রুম নিলাম। আমাদের রূম নম্বর ১৮।
রুমে এসে গোসল করে নিলাম। গত রাতে বাসে একটুও ঘুমাতে পারিনি। এখনও চেষ্টা
করছি ঘুমাতে কিন্তু ঘুমাতে পারি নাই। ঘুম যেন ভূতের মতো পালিয়েছে। কখন
সমুদ্র সৈকতে যাব সে অপেক্ষায় রইলাম। দুপুরে হোটেল অবকাশ আমাদের জন্য
খাবারের ব্যবস্থা করল। দুপুর ১টায় আমরা খেতে যাই। আমাদের খাবার দেয়া হল
কিন্তু খাবার এতই নিম্নমানের যে যা খাবার অযোগ্য। আমাদেরকে এমন একটি লবণ
দেয়া হল যা আমাদের এলাকায় গরুও খায় না। অথচ এখানে লবণ চাষ করা হয়! আমাদের
স্যাররা এ খবর পেয়ে সাথে সাথে ডিসির নিকট ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর মোবাইল
কোর্ট এসে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। স্যাররা সিদ্ধান্ত নিল এখানে থাকবে না।
সকালে অন্য হোটেলে চলে যাবে।
বিকাল ৪:৩০ মিনিটে আমরা সবাই বাসে উঠলাম।
ধীরে ধীরে বাস এগিয়ে যাচ্ছে সী-বীচের উদ্দেশ্য। বাস যতই সামনে যাচ্ছে ততই
আমাদের আনন্দ বেড়ে যাচ্ছে। ৫ মিনিটের মধ্যে বাসটি সী-বীচের সামনে এসে থামল।
সবাই বাস থেকে নেমে সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বালুর উপর দিয়ে জুতা পা
দিয়ে হাঁটতে পারছি না। তবুও হেলে দুলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সামনের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে তাকিয়ে দেখলাম দিগন্ত বিস্তৃত সাগর। শুধু পানি আর
পানি। যেন দুনিয়াব্যাপী এক গালিচা। ঐ সুদূর দিগন্তে সাগর আর আকাশ এমনভাবে
একাকার হয়ে গেছে যে তাদের আর আলাদা করা যায় না। তাদের মাঝে এত মিল দেখে
বুঝা যায় যে তারা একে অপরের সাথে কিভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
নূরুল হুদা স্যার আমাদেরকে সর্তক করে
দিয়েছেন ভাটার সময় যাতে সাগরে না নামি। তখন লাল পতাকা উড়ানো থাকে। আমি তখন
চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে দেখলাম এখন লাল পতাকা উড়ানো। তার মানে এখন ভাটা।
তাই আর ভয়ে সাগরের পানিতে নামিনি। কিন্তু সাগর যে আমাকে কাছে পেতে চায়।
আমি যত দূরেই দাঁড়াই না কেন সাগর এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে
ছবি তুলছিলাম। আর অমনি বিশাল ঢেউ এসে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমার সাথে ছিল
হাফিজ, নিশিথ, জুবায়ের। তাদেরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝাউগাছের দিকে চলে
গেলাম। সারি সারি ঝাউগাছ এক নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। গাছের ছায়ায়
ক্লান্ত পথিক প্রশান্তির জন্য এখানে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে চলে
আসলাম সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সূর্যের দিকে মুখ করে সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে
আছি। তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আমি দুনিয়াতে সব চেয়ে বেশি সুখী। আমার কোন
দুঃখ নেই। নেই কোন পাপ। আজ আমি মুক্ত, পবিত্র। দুনিয়ার সমস্ত কথা ভুলে
আনমনে তাকিয়ে আছি সূর্যের দিকে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যের পানে আমাদের
ক্যামেরাটি লকেট ল্যান্সের মতো তাক করে ক্লিক্ ক্লিক্ শব্দে সূর্য মামাসহ
কালো সেলুলয়েডের ফিতায় আমাদের চেহারা বন্ধি হয়ে গেল।
মুরগীর কুসুমের মতো সকাল বেলা সূর্য উঠে।
সেটি আভা ছড়ায় সারা পৃথিবীব্যাপী। পানির উপর ভাসতে থাকে সূর্য। সারাদিন
শেষে বিকেল বেলা সূর্য লাল টক টকে হয়ে যায়। পশ্চিমাকাশ যেন আগুনে পুড়ে
ছারখার হয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে সূর্যের ত্যাজ কমতে থাকে। এভাবে সূর্যের
ত্যাজ কমতে কমতে আমার চোখের সামনে লাল টকটকে থালার মতো সূর্যটি টুপ করে
সাগরের লোনা পানিতে ডুবে গেল। সত্যি এ এক অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু
বিদায়ী সেই লগ্ন আমার হৃদয়কে ব্যাথাতুর করে দিল। এই প্রথম কক্সবাজার সমুদ্র
সৈকতকে স্বচক্ষে দেখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হল। এতোদিন শুধু পত্র
পত্রিকায়, বইয়ে পড়ে, টেলিভিশনে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিলনা কক্সবাজার সমুদ্র
সৈকত যে এত সুন্দর। আজ হাজার হাজার মানুষ এক সাথে সূর্যাস্ত দেখছে। অবশ্য
এর আগে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দেখেছিলাম। তবে সেটা কক্সবাজারের মতো নয়নকাড়া
নয়। এখানে আছে ছাতা ও চেয়ার। ঘন্টা হিসেবে ভাড়া নিয়ে বসে এই অপরূপ দৃশ্য
অবলোকন করা যায়। সন্ধ্যা ৬টায় আমরা এখান থেকে বার্মিজ মার্কেটে যাই। যার
যার পছন্দ মতো কেনাকাটা করে ৯টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৯ তারিখ ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠি। দাঁত
ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে সাগরে গোসল করার জন্য খালি পায়ে গেঞ্জি ও প্যান্ট
পড়ে রওয়ানা হলাম। সাথে মোশারফ স্যার, হাফিজ, জুবায়ের, নিশিথ, সাবিনা,
মনিকা, মুনছুর ভাই, শৈলাস দাসহ আরো অনেকে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌনে পাঁচটায়
সাগরের তীরে চলে আসলাম। আজকে আমরাই মনে হয় প্রথম সাগরে আসলাম। অন্যকোন
লোকজন তখন দেখিনি। তারপর ধীরে ধীরে লোকজন এসে ভীড় জমালো। সবাই প্যান্ট
গুচিয়ে পানিতে নামলাম। এখন সাগরের তীরে সবুজ পতাকা উড়ানো দেখে বুঝতে পারলাম
পানিতে নামতে আর কোন ভয় নেই। আমি, জুবায়ের, নিশিথ, হাফিজ একদম কোমর পানিতে
নেমে গেলাম। আর ক্লিক্ ক্লিক্ করে ছবি তুলছি একে অপরের। বিশাল ঢেউ এসে
আমাদেরকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। লোনা পানিতে দাপাদাপি আর ঢেউয়ের তালে তালে
নাচানাচি করার মজাই যেন আলাদা। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম ঢেউ আসার সাথে সাথে
পায়ের নীচ থেকে বালুগুলো সরে যাচ্ছে। যখন বড় ঢেউ আসে তখন ডুব দিয়ে পানির
নিচে চলে গেলাম। একবার ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ড্রাইভ দিতে গিয়ে পড়ে যাই।
আজ সমুদ্রে গোসল করতে পেরে নিজেকে খুবই প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। মনে হয় যেন
সমস্ত পাপগুলো সাগরের লোনা পানিতে ধুয়ে গেছে। এখন যেন আমি নিষ্পাপ। মাছ
ধরা, ঝিনুক কুড়ানো, দৌঁড়াদৌড়ি সবই করলাম। তখন এতই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি
যে দুনিয়ার কথা সবই ভুলে গেলাম।
এদিকে কিছুক্ষণ পর সূর্য মামা পাহাড় ভেদ
করে পূর্ব আকাশে উদিত হলো। অগ্রহায়ণের জ্বলন্ত সূর্য ও তার ত্যাজ ধীরে ধীরে
পশ্চিমাকাশের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় দু’ঘন্টা সাগরের লোনা পানির সাথে
আলিঙ্গন করে হোটেলে ফিরে আসলাম। এখানে এসে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল
করলাম।
আজ আমরা লাইট হাউজের পাশে কলাতলীতে হোটেল
‘লেমিছ’ এ উঠলাম। এখান থেকে সী-বীচ খুব কাছে। আগের চারজনই এখানে রূম নিলাম।
আমাদের রুম নম্বর ৩০৮, ৪র্থ তলা। রূমে টিভি, টেলিফোনসহ সব সুযোগ সুবিধা
আছে। এর নীচে পউষালী রেস্টুরেন্ট এ আমরা সকালের নাস্তা করি। ১০:৩০ মিনিটে
আমরা দুলাহাজারা সাফারী পার্ক দেখতে যাই। ওখান থেকে ছটায় ফিরে আসি। ৪:৩০
মিনিটে হিলটপ সার্কিট হাউজে যাই। সোয়া পাঁচটায় সেখান থেকে আসার পথে আমি,
হাফিজ, নিশিথ, জুবায়ে চলে যাই সমুদ্র সৈকতে। তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। আমরা
চেয়ার ও ছাতা ভাড়া নিয়ে বসে রাতের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। বিশাল বিশাল ঢেউ
তীরে এসে ভেঙ্গে পড়ছে। হালকা বাতাসের ছন্দে ঢেউয়ের শো শো আওয়াজ কানে এসে
প্রবেশ করছে। এসব দৃশ্য দেখে অজানা ভালো লাগার আবেশে মন ভরে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে আমরা সেখান থেকে চলে আসলাম সমুদ্র সৈকতের পাশে ঝিনুক
মার্কেটে। এখানে এসে কিছু ঝিনুক ও শামুকের মালা কিনলাম। রাত ৮টায় বাসায়
ফিরে আসি। রাতে শোয়ার সময় লক্ষ্য করলাম লাইট হাউজ একদম কাছে। রাত্রে এখান
থেকে সমুদ্রের জাহাজকে সিগন্যাল দেয়া হয় যেন তীরে থেকে দূরে থাকে। এখানে
জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ বিধায় আমরা কেউ যেতে পারিনি।
পরদিন ২০ তারিখ। সকাল বেলা টেকনাফ হয়ে শীপে
করে সেন্টমার্টিন এ যাই। রাতে টেকনাফ এসে কেনাকাটা করি। রাত ১০টায়
কক্সবাজার হোটেল ‘লেমিছ’ এ এসে পৌঁছি। স্যার আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন
আগামীকাল সকাল ৭টায় নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। একথা শুনে আমাদের সকলের
মন ভেঙ্গে গেল। কিভাবে যে ৫দিন চলে গেল তা কেউ টেরই পেলাম না। এখানে এসে
আনন্দের সাগরে ভাসতে ভাসতে ভুলে গেলাম দিন, তারিখ, বার, দিক সবই। ২১ তারিখ
সকাল বেলা শৈলাস দা এসে ডাকাডাকি শুরু করল তাড়াড়াড়ি বাসে উঠার জন্য। মন
চাচ্ছেনা যেতে তবুও বাসে উঠলাম। ৭.৩০ মিনিটে বাস ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে বার
বার তাকিয়ে শেষ বারের মতো সাগরকে দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সাগরকে পিছনে
ফেলে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাত ১০:৩০ মিনিটে ক্লান্ত দেহ
নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন