সালাতুত তারাবি পবিত্র রমজান মাসের বিশেষ একটি ইবাদত। মাহে রমজানে রাতের বেলায় এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং তিন রাকাত বিতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, তাকে ‘তারাবি নামাজ’ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। তারাবি নামাজ পড়াকালে প্রতি দুই রাকাত বা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবি’। দীর্ঘ নামাজের কঠোর পরিশ্রম লাঘবের জন্য প্রতি দুই রাকাত, বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করে দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয় বলে এ নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
তারাবির নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, আদায় না করলে অবশ্যই গুনাহ হবে। তারাবির নামাজ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। কারণ মাহে রমজান যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য মহিমান্বিত তার মধ্যে অন্যতম হলো সালাতুত তারাবির নামাজ। তারাবির নামাজ মুসলমানদের ওপর সারা বছরের মধ্যে শুধুই রমজান মাসের জন্য সুন্নাত বিধান হিসেবে স্থিরকৃত। যেহেতু রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্য কোনো সময়ে তারাবির নামাজ আদায় করার সুযোগ নেই, তাই বার্ষিক ইবাদত হিসেবে এর গুরুত্ব অন্যান্য সুন্নাত নামাজ অপেক্ষা বেশি।
রাসুলে কারিম (স.) তারাবির নামাজকে অত্যন্ত গুরুত্বসহ আদায় করতেন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) তারাবির নামাজের ব্যাপারে সাহাবিদের উৎসাহিত করতেন কিন্তু তিনি তাঁদেরকে দৃঢ়তার সঙ্গে আদেশ করতেন না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ইমানের সহিত সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে রমজান মাসের রাতে কিয়াম করবে অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
মাহে রমজানে রোজা, তারাবি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুন আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মবিশ্লেষণের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রোজা রাখেন, তারাবি নামাজ পড়েন এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তারাবির নামাজ সুন্নাত মনে করে গুরুত্বহীন ভাবা উচিত নয়। যদিও এটা ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তারপরও সুন্নাতে মুআক্কাদাহ হিসেবে এর গুরুত্ব মোটেও কম নয়। বিজ্ঞ আলিমরা সুন্নাতে মুআক্কাদাহকে ওয়াজিবের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ তারাবির নামাজ বর্জন করলে অবশ্যই গুনাহ হবে। হজরত উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের (রা.) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার রমজান মাসে রাত্রিবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ (তারাবি) আদায় করলেন। উপস্থিত লোকজনও তাঁর সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। একইভাবে তাঁরা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হল। অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি এলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শুধুমাত্র এ ভয়ে আমি তোমাদের নিকট আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর উহা ফরজ করে দেওয়া হয়। (বোখারি ও মুসলিম)
রমজান মাসের জন্য নির্দিষ্ট তারাবি নামাজ জামাতে পড়া ও সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তারাবি নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবি নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা ও কোরআন শরিফ খতম করা অধিক সওয়াবের কাজ। তবে ঘরে সূরা-কিরাআতের মাধ্যমে আদায় করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তারাবি নামাজের জন্য রাতের কোনো বিশেষ সময়কে নির্দিষ্ট করে দেননি। তবে তারাবি নামাজ অবশ্যই এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে আদায় করতে হবে।
নবী করিম (সা.) বেশির ভাগ সময় রাতের শেষাংশে তারাবি আদায় করতেন এবং প্রথমাংশে বিশ্রাম নিতেন। তিনি কখনো আট রাকাত, কখনো ১৬ রাকাত, আবার কখনো ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু বিশেষ কারণবশত নিয়মিত ২০ রাকাত পড়তেন না। কেননা, তিনি কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। তবে ২০ রাকাত তারাবি নামাজ হওয়ার স্বপক্ষে দলিল সহিহ হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (সা.) রমজান মাসে বিনা জামাতে (একাকী) ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করতেন, অতঃপর বিতর নামাজ পড়তেন।’ (বায়হাকি)
হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবিদের ইজমা দ্বারা মূলত রমজান মাসের মধ্যে ২০ রাকাত তারাবি নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার রীতির প্রচলন হয়।
তারাবি নামাজের জামাতে পবিত্র কোরআন খতম করা হয়, তাই জামাতে তারাবি নামাজ পড়লে সওয়াব বেশি পাওয়া যায়। রমজান মাসে তারাবি নামাজের কিয়াম হলো আল্লাহর রাস্তায় আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করার শপথ অনুষ্ঠান। তারাবি নামাজের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ ও আল্লাহকে স্মরণ ও জীবনে সফলকাম হওয়ার জন্য স্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাগুলো ফরজ করেছেন এবং এর রাতে তারাবি নামাজের জন্য দ-ায়মান হওয়াকে অশেষ পুণ্যের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অতএব মাহে রমজানের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল তারাবির নামাজকে অবহেলা করে মহান আল্লাহর দেওয়া গুনাহ মাফের বিশেষ সুযোগ হাতছাড়া করা হবে চরম বোকার কাজ।
তারিখ: ১১/০৬/২০১৬ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন