তাপসকিরণ রায় পশ্চিমবাংলার কবি। তিনি ১৯৫০ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা র্স্বগীয় শৈলেশ চন্দ্র রায়। মা শ্রীমতী বেলা রায়। র্বতমানে তিনি ভারতের মধ্য প্রদশেরে জবলপুর শহরে বাস করেন। বাংলা বিভাজনের ফল-স্বরূপ ফেলে আসতে হয়েছে
জন্মভূমিকে। ফেলে আসতে হয়েছে ভিটামাটিকে। হাজার
হাজার বিঘা সোনা ফলা জমিকেও। ১৯৫১ সালে বাবা মা, তাঁকে নিয়ে পশ্চিম বাংলার র্বধমান
শহরে এসে উঠছেলিনে। ছোট বেলায়
স্বাভাবিক নিয়মে বাবা মায়ের সঙ্গে ঘুরতে হয়েছে বর্তমান, কলকাতা রানাঘাট। সবটাই সংসার জীবনরে টানা পোড়নেরে হাত ধরে। অতএব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে বাবা মায়ের
হাত ধরে ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে পৌঁছালেন দন্ডকারন্য প্রজেক্ট-এ। প্রজক্টে থেকে আবেদনের
ভিত্তিতে পিতা শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। কবিকেও আর্থিক অসঙ্গতির জন্য প্রাথমিক শিক্ষকের
কাজ নিতে হয়। পরে পদোন্নতি হয় হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বি.এ পাশ করেন। রায়পুর রবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ করেন। বি.এড ডিগ্রী
পান ভোপাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রকিায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য তাঁর লেখা অনেকগুলি বইও
প্রকাশিত হয়েছে। পনের বছর বয়স থেকে পত্র
পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। প্রথম দিকে স্থানীয় বাংলা পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।
কবিতায় বেশি লিখছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কলকাতার বেশ কিছু পত্রিকায় লেখা
ছাপে। এর মধ্যে শ্রদ্বেয় বিমল চন্দ্র মিত্র সম্পাদিত “কালী ও কলমে” আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের পত্রিকা “বেতার জগতে” রেডিও
কেন্দ্রের “মজদুর মণ্ডলীর আসরের” পরিচালক সত্যচরণ ঘোষের “আসর” পত্রিকা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া কবির লেখার ওপর আলোচনা
প্রকাশ পেয়েছিল “যুগান্তর” পত্রিকায়।
১৯৭১-এর
পর ব্যক্তিগত কারণে লেখা প্রায় বন্ধ থাকে র্দীঘ চল্লিশ বছরের ওপর। এ সময়টায় কিছু হিন্দি
কবিতা লিখেছেন। তার মধ্যে বেশ কিছু প্রকাশিত হয়েছে নব ভারত, দশবন্ধু, দৈনিক
ভাস্কর, নবীন দুনিয়া প্রভৃতি পত্রিকায়। বেতারেও কবির চার-পাঁচটি কবিতা পাঠের
অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে এবং লেখার সূত্র ধরে কবির সাথে শ্রদ্বেয় তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এবং বিমল মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে পত্রালাপ ছিল। বিমল মিত্রের
সঙ্গে লেখকের একাধিকবার সাক্ষাতও হয়।
জলছবি বাতায়নের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন গল্পকার আমির
ইশতিয়াক। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাঁর লেখালেখির অজানা কিছু তথ্য। তার চিন্তার নানা
দিক।
জলছবি বাতায়তনঃ জলছবি বাতায়নে সাক্ষাতকার দিতে সম্মত হওয়ায় জলছবি বাতায়নের লেখক-পাঠকদের পক্ষে থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন। কেমন আছেন ?
তাপসকিরণ রায়: ভাল আছি। ভাল মন্দ নিয়েই ভাল
থাকা। মন্দ না থাকলে ভাল আছি এ কথা বুঝবো কি ভাবে? দুঃখে আছি একথাও বলতে পারি কারণ
আমি যে সুখের সাথেও পরিচিত। তবে এত সব বলতে নেই, যেমনটাই থাকি না কেন, বলতে হয়,
ভাল আছি।
জলছবি বাতায়তনঃ আপনার জন্মসাল, স্থান এবং বাবা-মা, ভাইবোন সমপর্কে জানতে চাই?
তাপসকিরণ রায়: আমার পিতার নাম স্বর্গীয় শৈলেশ চন্দ্র রায়। সরকারী চাকরী থেকে অবসর গ্রহণের পর ছত্তিস গড়ের রায়পুরে
নিজের বাড়িতে বসবাস করতেন। সারাটা জীবন বাবার চিরসাথী হয়ে থেকেছেন আমার মা, শ্রীমতী বেলা রায়। সংসারের সমস্ত ভার বোঝা,
সুখ দুঃখ সহন করে আজও তিনি পৈতৃক বাড়ি আগলে আছেন। আমার জন্মস্থান: ঢাকা, বাংলাদেশ। আমার জন্ম তারিখ: ১৫ই এপ্রিল, ১৯৫০। আমার দুই ভাই। ওঁরা যার যার জাগায় সুপ্রতিষ্ঠিত। বড় ভাই পশ্চিমবঙ্গে আর ছোটভাই পৈতৃক বাড়িতে বাস
করছেন।
স্বর্গীয়
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশনায় কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে আমার কাব্যগ্রন্থঃ চৈত্রের খরায় নগ্ন
বাঁশির আলাপ, শিশু বিতান প্রকাশনী থেকে শিশু ও কিশোর গল্প গ্রন্থঃ গোপাল ও অন্য
গোপালেরা, রাতের ভূত ও ভূতুড়ে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। আমার গল্প সঙ্কলন, গুলাবী তার নাম। এ ছাড়া প্রসাদ, রোদের রং, কবিতা মঞ্চ, তবুও প্রয়াস, দিগন্ত, নিরুক্ত, কবিতার
সাত কাহন, অঙ্কুর ইত্যাদি
বেশ কিছু পত্রিকায় আমার গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে।
আমার দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ, তবু বগলে তোমার
বুনো ঘ্রাণ, প্রকাশিত
হয়েছে। এ ছাড়া ঐহিক, কলামটি, কৌরব, আদরের নৌকা, সৃষ্টি, পরবাস ইত্যাদি আরো কিছু অনলাইন পত্রিকাতেও আমি নিয়মিত লিখি।
জলছবি বাতায়তনঃ আপনার লেখালেখির শুরু ও অনুপ্রেরণার কথা যদি বলেন?
তাপসকিরণ রায়: ছোট বেলা থেকে
আমার ছোটদের বড়দের সব রকম বই পড়ার ঝোঁক ছিল। পড়তে পড়তে মনে হত, ইচ্ছে হলে আমিও তো
লিখতে পারি—আবার আকাশ,
চাঁদ, বনভূমি এ সব প্রাকৃতিক দৃশ্য মনকে বেশ উতফুল্ল করত। এভাবেই একদিন কাগজ কলম টেনে
নিয়ে বসে গিয়েছিলাম লিখতে। লেখা বলতে কবিতা দিয়েই আমার শুরু। শুরুর লেখাগুলি ছিল
ছন্দ মিলের কবিতা। লিখেছি তেইশ বছর পর্যন্ত। তারপর নিয়ে ছিলাম দীর্ঘ বিরাম। কর্ম
আর বিবাহ ধর্মের ব্যস্ততা সামলাতে গিয়ে সব লেখালেখি বলতে গেলে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
জীবনের মাঝখানে কিভাবে যেন সামান্য বোধোদয় ঘটে ছিল—হিন্দীতে কিছু কবিতা লিখে ছিলাম। সেগুলি নব ভারত, দৈনিক
ভাস্কর, নবীন দুনিয়া, পত্রিকা ইত্যাদি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বেতারে তার প্রসারণও হয়েছিল।
জলছবি বাতায়তনঃ সাহিত্যে প্রাচীন যুগ, তারপর মধ্যযুগ। এরপর আমনে হত ধুনিক যুগ। উত্তর আধুনিক বলে যে কথাটি প্রচলিত তার সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যের দ্বন্দ্ব আছে বলে মনে করেন?
তাপসকিরণ রায়: উত্তর আধুনিক আর আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের কোন নির্দিষ্ট বিষয় স্থিরীকৃত থাকে না। উত্তর-আধুনিকতা আদর্শ অনাদর্শের
ধার ধারে না। এক উদ্ধত দিশা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শ এতে লক্ষ্য করা যায়। সৃষ্টির নতুন দিশার অন্বেষণে কলমের স্বাধীনতা খুঁজে ফেরে উত্তর আধুনিক সাহিত্য। আর তার বিপরীতে
আধুনিক সাহিত্য, এক নীতিগত আদর্শ সামনে নিয়ে সৃষ্টির পথে এগিয়ে যায় আধুনিক
সাহিত্য।
জলছবি বাতায়তনঃ লেখকরা আত্মকেন্দ্রীক হয়, অনেকেই বলেন। নিজের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
তাপসকিরণ রায়: আমি ভাবি কথাটা
শুধু লেখকদের জন্যে নয়, যশ সম্মান আর্থিক সম্পন্নতা পাবার পরেই মানুষ
আত্মকেন্দ্রীক হয়ে ওঠে। নিজের
সমতায় সে আর কাউকে দেখতে চায় না। এর ব্যতিক্রম নেই তা বলব না। তবে আমি কি
ব্যতিক্রমী? কথাটা আমি না, আমার সংশ্রবে থাকা ব্যক্তিরাই সঠিক বলতে পারবেন।
জলছবি বাতায়তনঃ কেন লেখেন? এ প্রশ্ন নিজেকে কখনও করেছেন কি?
তাপসকিরণ রায়: মানসিক শান্তির জন্যে লিখি। লেখার এক সৃজন
কথা থাকে—কোন লেখা
লেখককেই আকৃষ্ট করে নেয়। সে লেখা গল্প হোক বা কবিতা যেন মনের মাঝে উচ্ছ্বাস,
স্বাচ্ছন্দ এনে দেয়। জীবনের সুখ দুঃখ বাস্তব হয়ে উঠে এসে কোন লেখা হয়ে ওঠে
মর্মস্পর্শী। আবার কখনও লেখা হয়ে ওঠে তোমাদের আমাদের জনগণের। সমস্ত জীবনের ধারা
প্রবাহ ধরা পড়ে লেখনী আঁচড়ে। নিজের এই সৃষ্টি গাঁথা নিজের কাছে খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে গল্প কাহিনীর চরিত্রের মাঝে লেখকও মিশে যান। সুখ দুঃখের নায়ক নায়িকার
সাথে লেখক একাত্ম হন, তাদের শরিক হন, তাদের সঙ্গে লেখক হাসেন, কাঁদেন, গান। সে যেন
অন্য এক জগত—আর সে জগতের
কর্ণধার স্বয়ং সে লেখক!
কে
জানে কেন লিখি? মনকে প্রশ্ন কর দেখি সে কি বলে।
হ্যাঁ—নিশ্চয় অর্থের দিকে তাকিয়ে
নয়—অন্তত শুরুর দিকে। নিজেকে বড়
লেখক তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়। আমি নামি দামী লেখক হব—লোক আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে—এ কামনা কার না থাকে?
জলছবি বাতায়তনঃ লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন মাধ্যমটি আপনার প্রিয়?
তাপসকিরণ রায়: পত্রপত্রিকা,
বিশেষ করে ছাপার মাধ্যমকে আমি প্রাথমিকতা দিই। তবে নতুন লেখকদের কিন্তু অনলাইন বা
ব্লগ মাধ্যম সুবিধা জনক। কারণ অনলাইন বা ব্লগগুলিতে নিজের লেখা স্বাধীন ভাবে নিজেই
পোস্ট করতে পারা যায়। আর এতে সুবিধা এই যে পাঠকেরা এ সব লেখার ভালমন্দ বিচার করে
নতুন লেখকদের পথনির্দেশ দিতে পারেন। নবীন লেখকের লেখার শুরুর পর্ব মানে লেখার
পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অনুশীলন অনলাইন বা ব্লগ মাধ্যমে সম্ভব। লেখা কিছু পাকা হলে
তারপর ছাপা পত্রপত্রিকায় লেখকদের প্রবেশ ঘটা সহজতর হয়ে উঠতে পারে। এরপরে নামি দামী
পত্রিকায় লেখক মান্যতা পান।
জলছবি বাতায়তনঃ কেন?
তাপসকিরণ রায়: একই কথা বলতে
হয়, অনলাইন বা ব্লগগুলিতে নিজের লেখা স্বাধীন ভাবে নিজেই পোস্ট করতে পারা যায়। আর
এতে সুবিধা এই যে পাঠকেরা তার লেখার ভালমন্দ বিচার করে নতুন লেখকদের পথনির্দেশ দিতে
পারেন। নবীন লেখকের লেখার শুরুর পর্ব মানে লেখার পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অনুশীলন ব্লগ
বা অনলাইন মাধ্যমে সম্ভব। লেখা কিছু পাকা হলে তারপর ছাপা পত্রপত্রিকায় লেখকদের
প্রবেশ ঘটা সহজতর হয়ে ওঠে। এরপরে নামি দামী পত্রিকায় লেখক মান্যতা পান।
জলছবি বাতায়তনঃ বলা হয়ে থাকে কাদম্বিনী দেবীর অনুপ্রেরণা না পেলে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতেন না ? সমালোচকদের এ কথাটির গুরুত্ব কতটুকু?
তাপসকিরণ রায়: কাদ্মবিনী দেবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্যতা ছিল। অনেকটা
ভালবাসাবাসির পর্যায়ে ছিল এ সখ্যতা। কাদম্বিনী রবীন্দ্রনাথের লেখার খানিকটা
প্রেরণা যুগিয়েছেন এ কথা ঠিক। ভালবাসা বা ভাল লাগার ওপরে তাঁর লেখা কিছুটা পূর্ণতা
পেয়ে থাকবে নিশ্চয়। কিন্তু তা কতটা? কাদম্বিনী দেবী মারা গিয়ে ছিলেন মাত্র ২৫ বছর
বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তখন মাত্র ২৩
বছরের। রবীন্দ্র নাথের বিবাহের চার মাস পরেই কাদ্মবিনী দেবী আত্মহতা করেছিলেন।
তিনি ঠাকুর বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসেন মাত্র ৯ বছর বয়সে, জ্যতিরিন্দ্র নাথের সঙ্গে।
জ্যতিরিন্দ্রের তখন বয়েস ছিল ১৯। কাদ্মবিনীর বিয়ের অনেক বছর পরে রবীন্দ্র নাথের
সঙ্গে তার প্রণয় সম্বন্ধ ঘটে। ইতিমধ্যে রবিঠাকুর বেশ ক’বছর বিলেতেও ছিলেন। আর এ ধরণের সম্বন্ধ মানুষকে লেখায়
উদবুদ্ধ করার চেয়ে উৎকণ্ঠিত বেশী করে। অবৈধ আড়াল প্রেমের শত্রুতা থাকে পদে পদে--পাওয়া না পাওয়ার
হতাশা এমনি সময়ে মানুষকে অস্থির অস্বাভাবিক বিকার ভাবনায় নিয়ে আসে। আর এ কথাও ঠিক,
কাদ্মবিনী দেবী রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে খুব বেশী দিন ছিলেন না। তাই এ সব কিছু
মিলিয়ে আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়েই থাকতেন বরং সাহিত্য সৃষ্টির দিক
থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে থাকতেন যদি তাঁর জীবনে কাদম্বিনী দবী না আসতেন।
জলছবি বাতায়তনঃ বিশ্বকবির কোন ধরনের সৃষ্টি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
তাপসকিরণ রায়: প্রকৃতি নিয়ে
লেখা—যেমন তাঁর লেখা, সমুদ্রের
প্রতি—ভাব ভানার গুঢ় উচ্চারণ খুঁজে
ফিরি যেখানে—
হে আদিজননী সিন্ধু,বসুন্ধরা সন্তান তোমার,
একমাত্র কন্যা তব কোলে। তাই তন্দ্রা নাহি আর
চক্ষে তব, তাই বক্ষ জুড়ি সদা শঙ্কা, সদা আশা,
সদা আন্দোলন; তাই উঠে বেদমন্ত্রসম ভাষা
নিরন্তর
প্রশান্ত অম্বরে,
মহেন্দ্রমন্দির-পানে
অন্তরের অনন্ত প্রার্থনা, নিয়ত মঙ্গলগানে
ধ্বনিত করিয়া দিশি দিশি; তাই ঘুমন্ত পৃথ্বীরে
অসংখ্য চুম্বন কর সর্ব অঙ্গ ঘিরে...
জলছবি বাতায়তনঃ আপনার লেখালেখিতে কার অনুপ্রেরণা আপনাকে উজ্জীবিত করে?
তাপসকিরণ রায়: আমি তারাশঙ্কর
বন্দপাধ্যায় ও বিমল মিত্রের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত। লেখার ক্ষেত্রে এঁরা এক সময়
আমায় পত্র দ্বারা উৎসাহিত করেছিলেন।
জলছবি বাতায়তনঃ জীবনানন্দ দাশ থেকে হালের নবীনতর কবির লেখার মধ্যে কী কী পার্থক্য আপনার দৃষ্টিগোচর হয়?
তাপসকিরণ রায়: জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবিতার সূত্রধার বলা যায়—নবীন কবির দল পুরনো ভাব ভাবনাগুলিকে ভেঙে চুড়ে লেখার চেষ্টা
করছেন—কেউ কেউ আবার তার মধ্যেই আরও
উত্তর আধুনিকতা, পুনরাধুনিতকার সোচ্চারে মুখোর হচ্ছেন। কবিতা নতুন ভাবে পরীক্ষা
নিরীক্ষার মাঝে এগিয়ে চলেছে বলা যায়।
জলছবি বাতায়তনঃ নবীন লেখকদের সম্পর্কে বলুন—
তাপসকিরণ রায়: মানুষ মাত্রেই
তাঁর জীবনের চলার পথে কিছু না কিছু লেখেন। এ লেখা যারা চালিয়ে যেতে পারেন, নিজেকে
লেখক হিসাবে জাহির করতে চান অনুশীলন তাঁদের পক্ষে জরুরী কথা। হ্যাঁ আরও একটা কথা এ
সঙ্গে পাঠকের প্রশংসা অপ্রশংসা দু দিকই থাকে। লেখক হতে গেলে মাঝপথে থেমে গেলে চলবে
না। লিখতে লিখতেই তাকে প্রবীণ হতে হবে।
জলছবি বাতায়তনঃ তরুণদের অভিযোগ আছে, প্রবীণ লেখকরা তাদের মূল্যায়ন করেন না, এমন কি সৌজন্য কপি দিলেও ছুঁয়েও দেখেন না। আপনি কী বলেন? কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলে শেয়ার করতে পারেন? অথবা পক্ষেও বলতে পারেন।
তাপসকিরণ রায়: কথা অনেকাংশে
সত্য। প্রবীণ লেখকরা নবীনের মূল্যায়ন করতে চান না, সেটা বোধহয়
অনেকটা নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় নিজের অজান্তেই কাজ করতে থাকে। সৌজন্য কপি দিলেও ছুঁয়েও দেখেন না, এ কথাটা ঠিক নয়, সময় পেলে তাঁরা দেখেন—কিন্তু মুল্যাঙ্কন করতে চেষ্টা করেন না।
জলছবি বাতায়তনঃ জীবনানন্দ দাশের পর বাঙলা সাহিত্যের সেরা আধুনিক কবি কাকে মনে করেন? কেন?
তাপসকিরণ রায়: জীবনানন্দ দাশের পর বাঙলা সাহিত্যের সেরা আধুনিক কবি শক্তি চট্যপাধ্যায়কে মনে করি। সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্য
ধারায় তাঁর অনন্য সৃষ্টি মানুষের মন জয় করতে পেরেছে। বন্ধুত্ব, নারী, মানব সংসর্গ, জীবনের আনন্দ ও ব্যর্থতা রোধ নিয়ে তার কবিতা। প্রকৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ, নারীর ভালোবাসা প্রভৃতি তার কাব্য জগতে প্রধান উপকরণ হয়ে দাড়ায়। তার নিজস্ব ছন্দ এবং বলিষ্ঠ ভাষা তাকে বিশিষ্ঠতা দান করেছিল। সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৭৫ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৪ সালে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
জলছবি বাতায়তনঃ আপনি নিশ্চয়ই বললেন, বাঙালী বলে আপনি গর্বিত, বাঙলা ভাষা আপনার অহংকার। বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক কোনটি। দুর্বল দিকটিও বা কি?
তাপসকিরণ রায়: আধুনিক পর্যায়ের বাংলা ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গদ্যভাষার লিখন-চর্চা, প্রসার লাভ, উন্নয়ন ও কার্যকর ব্যবহার। এ ছাড়া কবিতার আধুনিকতার
তুমুল আলোড়ন চলছে বাংলা ভাষায়। এর দুর্বল দিক হল লেখার হিড়িকে লেখক হারিয়ে যাচ্ছে।
গোষ্ঠী দলাদলির মাঝেও আসল লেখা মান পাচ্ছে না। প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতা পয়সার কথা
বেশী ভাবছেন। প্রকৃত সাহিত্য এভাবেও বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জলছবি বাতায়তনঃ গদ্য বা পদ্য চর্চায় ওপার বাংলা ও এপার বাংলার পার্থক্য জানতে চাই।
তাপসকিরণ রায়: কিছু আঞ্চলিক
ভাষার ব্যবহার দেখা যায়—দুই বাংলার
প্রকাশ ভঙ্গীতে কিছুটা পার্থক্য নিয়ে আসে কিন্তু সেটা যৎসামান্য বলতে হয়। বর্তমানে একই
স্রোতে বয়ে চলেছে দুই বাংলার ধারা। কবিতার দিক থেকে গ্রামবাংলা পুরনো ধারাকে এখনও
সম্পূর্ণ বদলাতে পারেনি। এটা উভয় বাংলার কথাই বলছি।
জলছবি বাতায়তনঃ কলকাতা বইমেলায় প্রতি বছর প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। নবীনদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহ বেশ লক্ষ্য করা যায়। অথচ প্রকাশকরা নবীনদের বই প্রকাশ করতে চান না। করলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রতারণার শিকার হন। আপনার কি কোন অভিজ্ঞতা আছে?
তাপসকিরণ রায়: কলকাতার বইমেলা
উপলক্ষে আমার ৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে আজ থেকে চার পাঁচ বছর আগে। বলা বাহুল্য
প্রকাশকের টাকায় নয়। কারণ প্রকাশকরা নবীনদের বই ছাপতে চান না। কারণ লাভের দিকটাই
তাঁদের নজরে আসে বেশী। নিজের ব্যয়ের পরেও প্রকাশকরা আমার প্রত্যেক বইয়ের ১০ থেকে
১৫ কপি বই আমায় দিয়ে বাকি বই বিক্রির নামে আজ পর্যন্ত অবিক্রিত ফেলে রেখেছেন। আদৌ
কথামত বই ছাপানো হয়েছিল কিনা এটাও একটা প্রশ্ন থেকে গেছে। প্রকাশকদের কাছ থেকে কোন
রকম হিসাব পত্র পাইনি। অবশ্য আমি বাংলার বাইরে থাকি বলেই হবে আমার এ ব্যপারে আমার
অবস্থাটা বড় বেশী দৈন্য।
জলছবি বাতায়তনঃ কলকাতা বইমেলায় বাঙলাদেশী স্টলগুলোতে গিয়েছেন কখনও? কেমন লাগে বাংলাদেশী লেখকদের লেখা?
তাপসকিরণ রায়: হ্যাঁ—একবার গিয়ে ছিলাম কলকাতা বইমেলায়, সেবার বাংলাদেশী স্টলে ঢুকে ছিলাম। ইসলাম ধর্মের
ওপর কিছু ধার্মিক বই কিনেছিলাম মনে আছে। তবে বাংলাদেশী লেখকদের লেখা অনেক বই আমি
পড়েছি।
প্রতিনিয়ত অনলাইনে অনেক বই পড়ছি।
জলছবি বাতায়তনঃ পশ্চিমবাংলার কোন কোন লেখকের লেখা আপনি বেশি পছন্দ করেন?
তাপসকিরণ রায়: সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মখোপাধ্যায়, শক্তি চত্যপাধ্যায়ের লেখা।
জলছবি বাতায়তনঃ বাংলাদেশে আপনার প্রিয় লেখক কে কে?
তাপসকিরণ রায়: হুমায়ূন আহমেদ, আবেদ খান, রাকিব হাসান, শাহজাহান চৌধুরী, আখতার হুসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,
জসিমুদ্দিন, আহামদ আলী, মুশাররাফ করিম ইত্যাদি।
জলছবি বাতায়তনঃ পশ্চিমবাংলার অনেক লেখকেরই আদিবাস বাংলাদেশে। আপনার সে রকম চেনাশুনা কেউ কি আছেন পূর্ববাংলায়?
তাপসকিরণ রায়: না--এ মুহূর্তে
তেমন কাউকে মনে করতে পারছি না।
জলছবি বাতায়তনঃ কখনও কি বাংলাদেশে এসেছেন? বাংলাদেশের কোন দিকটি আপনার ভালো লাগে।
তাপসকিরণ রায়: বাংলাদেশে আমার
জন্ম। জন্মের পরে পরেই চলে আসি পশ্চিম বাংলায়। তারপর আট দশ বছর বয়সে ঘুরতে গেছি।
তখন কার বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজও যেন চোখ ছুঁয়ে আছে!
জলছবি বাতায়তনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বন্ধু হিসাবে শরণার্থীদের আশ্রয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহায়তা করেছে। সে সময়ের কোন স্মৃতি কি আপনার মনে পড়ে?
তাপসকিরণ রায়: সামান্য, কারণ
আমি পশ্চিম বাংলার বাইরে থাকতাম। সংবাদ পত্রের মাধ্যমে যেটুকু জেনেছি।
জলছবি বাতায়তনঃ বাধ্য হয়ে নবীনরা প্রকাশকদের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন। আপনার দৃষ্টিতে এর বিশ্লেষণ চাই?
তাপসকিরণ রায়: অপরের ২২ নম্বর
প্রশ্নের উত্তরে এটা উল্লেখ করেছি। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রকাশকরা নবীনদের
বই ছাপতে চান না। কারণ লাভের দিকটাই তাঁদের নজরে আসে বেশী।
জলছবি বাতায়তনঃ আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সম্পাদকরা নতুনদের লেখা প্রকাশ করতে চান না, এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু?
তাপসকিরণ রায়: এখানেও একই
ব্যাপার জড়িত, সম্পাদকের নজরে এখানেও লাভের দিকটা জড়িত আছে। পরিচিত নামি দামী
লেখকের লেখাতেই পত্রিকার কাটতি বেশী।
জলছবি বাতায়তনঃ অনলাইনে অনেকেই লিখছে আজকাল। অনলাইন লেখকদের ভবিষ্যত সম্পর্কে বলুন। অনলাইন লেখকদের মধ্যে কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?
তাপসকিরণ রায়: অনলাইন বড় একটা
লেখার জরিয়া। এখনকার লেখকের হাতে খড়ি বলতে গেলে এই অনলাইন। অনুপম মুখোপাধ্যায়, কবি
রেজা, মেঘ আদিতি, বারিন ঘোষাল, সায়ান ইমতি ইত্যাদি ইত্যাদি।
জলছবি বাতায়তনঃ মনে করুন, বলা হলো আপনি আজ থেকে আর লিখবেন না। এই বিধিনিষেধকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন আপনি?
তাপসকিরণ রায়: খুব কষ্টের
ব্যাপার হবে। তবে পড়ার দরজা তো খোলা থাকবে অগত্যা বই ম্যাগাজিন পড়ে দিন গুজার করতে
হবে আর কি!
জলছবি বাতায়তনঃ আপনার প্রকাশিত বই কী কী?
তাপসকিরণ রায়: আমার প্রথম
কবিতার বই শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশনায় ‘চৈত্রের খরায় নগ্ন বাঁশির আলাপ’। শিশু কিশোরদের জন্যে আমার লেখা দুটি বই হল, ‘গোপাল ও অন্য গোপালেরা’ ও ‘ভূত ও ভূতুড়ে গল্প’। আমার দ্বিতীয়
কাব্যগ্রন্থ, ‘বগলে তোমার বুনো
ঘ্রাণ’। এ ছাড়া আমার গল্পগ্রন্থ ‘গুলাবী তার নাম’।
জলছবি বাতায়তনঃ বর্তমানে কী লিখছেন বা পড়ছেন?
তাপসকিরণ রায়: বর্তমানে একটি
উপন্যাস লেখার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি। মধ্য প্রদেশের পাতালকোট আদিম বাসিন্দাদের
জীবন প্রণালীর ওপর লিখব ঠিক করেছি। এ জন্যে কিছু রেফারেন্স বই দেখছি।
জলছবি বাতায়তনঃ জলছবি সাহিত্য বাতায়ন হলেও এক সময় ব্লগের মতো সরাসরি লেখা প্রকাশ করা যেতো। বর্তমানে সে অবস্থা বন্ধ করে সম্পাদক লেখকদের নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করেন, বিষয়টির প্রতি আপনার মতামত চাই?
তাপসকিরণ রায়: উন্নত ব্লগের
লক্ষণ এটা। আনাড়ি লেখকের ওপর কোন ব্লগ ছেড়ে রাখা ঠিক নয়। লেখার ওপরে অনেক সময়
সম্পাদনার প্রয়োজন হয়। তাতে লেখার মান ও অভিরুচি বজায় থাকে। জলছবির ক্ষেত্রেও এটা
কাম্য ছিল বলে মনে করি।
জলছবি বাতায়তনঃ আপনার ব্যক্তিগত সুখ-দু:খ, আনন্দবেদনা যদি শেয়ার করতেন?
তাপসকিরণ রায়: মানুষের ওপরের
হাসি-খুশি ভাব দেখে আন্দাজ করা যায় না যে মানুষটি প্রকৃত সুখি কি না—হতে পারে তাঁর বুকেও গভীর দুঃখের ক্ষত লুকনো আছে!
জলছবি বাতায়তনঃ কষ্ট পান মাঝে মধ্যে, অভিমানও হয়। তখন আপনার মানসিক প্রতিক্রিয়া কি হয়?
তাপসকিরণ রায়: গভীর কষ্ট পেলে
আমি কবিতা লিখি—ভাঙনের কবিতা,
ছন্নছাড়া জীবনের কবিতা...
জলছবি বাতায়তনঃ নবীনদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
তাপসকিরণ রায়: থেমে গেলে
লেখকের মৃত্যু—কাঁচা লেখাও
অনুশীলনে হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে পারে।
জলছবি বাতায়তনঃ জলছবিতে সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তাপসকিরণ রায়: জলছবি বাতায়নে
সাক্ষাতকারের সুযোগ পাওয়ায় সত্যি আমি কৃতজ্ঞ। জলছবির পরিবারের সমস্ত সদস্যদের
প্রতি জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
সাক্ষাতকার
গ্রহণে আমির ইশতিয়াক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন