মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

নাকফুল

প্রতিদিনের মতো আজও পাখির কিচিরমিচির ডাকে জোনাকীর ঘুম ভাঙে। ব্রাশ নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে যায়। দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে আয়নার সামনে আসে। মুখে ক্রিম দিতে আয়নায় চোখ রাখে। তারপর বের হয়ে পড়ে উঠান ঝাড়ু দিতে। বিয়ের পর থেকে সকালে উঠেই আয়না দেখাটা প্রতিদিনের অভ্যাস হয়েছে ওর। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজ আয়নায় মুখ পড়তেই চমকে উঠলো জোনাকী! আঙুলের আগায় আজ আর ক্রিম উঠেনা। নিজের মুখের প্রত্যেকটা ভাঁজ ওর খুব চেনা। এইজন্যই বোধহয় এক পলকেই খালি নাকটা নজড়ে পড়লো। নাক স্পর্শ করে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সোনার নাকফুলটা নাকে নেই!
এইতো এক মাস পূর্বে বিয়ে হল কবিরের সাথে জোনাকীর। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে এই বাড়িতে যখন জোনাকী আসে তখন তার শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল সোনার নাকফুলটি। সেদিন থেকে অন্য একটা জীবন শুরু হলো জোনাকীর। নাকফুলটা পড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ি বলেছিলো, মেয়েদের নাকফুল হারালেই স্বামীর অমঙ্গল হয়। দাদীর মুখেও অনেকবার শুনেছে এতে সংসারের অমঙ্গল হয়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। অভাবের সংসার, টানাটানি করে কোন রকমে চলে। এই অবস্থায় এত দামী একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছে সে। একথা কেমন করে জানাবে স্বামী, শাশুড়িকে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে ঘরের কোনায়, বিছানায় সারা উঠোনের ময়লা-আবর্জনার মাঝে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে জোনাকী।  
এমন সময় কবিরের মায়ের চোখে ধরা পড়ে বিষয়টি। নাকফুল নেই নতুন বউয়ের নাকে। কবিরের মা চড়া গলায় বললো, এই পোড়ামুখী তোর নাকফুল কই? 
হঠাৎ শাশুড়ির এমন প্রশ্নে জোনাকী ভয় পেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, আম্মা কই পড়ছে, জানি না। সারা বাড়ি খুজছি কোনখানে পাইনি।
- তুইতো আমার পোলার অমঙ্গল ডাইক্কা আনছিস।
- এইসব কি কন আম্মা!
ততক্ষণে পুরো গ্রামের বৌ-ঝিদের মাঝে খবর রটে যায় নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রামের লোকেদের প্রাচীন একটি ধারণা নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়া অশুভ লক্ষণ। এতে অমঙ্গল হয় স্বামীর। ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন কবিরের মা। মায়ের কান্না শুনে ঘুম ভাঙে কবিরের। বাইরে এসে সব কিছু জানতে পেরে নাকফুল খুঁজতে থাকে কবিরও। কোথাও নাকফুল খুঁজে না পেয়ে হতাশায় ভোগছে কবিরও। তার মা জোনাকীকে ইঙ্গিত করে আরো অনেক কথা শুনায়। লজ্জায় অপমানে ঘরের দরজার একপাশে মুর্তির মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জোনাকী। কবির তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে।
আজ কিছুই মনে পড়ছে না জোনাকীর। এমন অনভুলা কেমনে হল তা ভাবতে পারছে না সে। মনে করার চেষ্টা করছে কখন সে শেষ বারের মতো নাকফুলটাকে দেখেছে? মনে পড়ে জোনাকীর। আগের দিন রাতে গোসলের সময় কবিরের দুষ্টমিতে নাকে আঘাত পেয়েছিল জোনাকী। তখন নাকফুলটা নাকে লেগেছিল। তখন হয়তো টিউবওয়ের পাড় পড়েছিল। 
কবিরকে জানায় সে কথা। কবির তখন জোনাকীকে নিয়ে টিউবওয়েলে পাড় খোঁজাখুজি করে। কিন্তু এত ছোট্ট একটি সোনার নাকফুল কি ততক্ষণে টিউবওয়েলের পাড় পড়ে রইছে? কাদা পানিতে ভেসে হয়তো মাটির নিচে কোথাও চলে গেছে। 
কবির কিছুক্ষন চুপ করে ভেবে বললো, চল্ আর বিছারতে হবে না। আমি তোরে আবার নাকফুল কিন্না দিমু।
কবির তাদের গ্রামের পাশেই একটি কারখানায় চাকরি করে। অল্প টাকা বেতনে চাকুরি করে কোন রকমে সংসার চালায়। সংসার বলতে মা-বাবা, স্ত্রী ও ছোট্ট একটি বোন। 
নাকফুল হারানোর সপ্তাহখানেক পর। অন্যান্য দিনের মতো আজও কাজ করতে কারখানায় যায় কবির। প্রতিদিনই সন্ধ্যার আগে কবির বাসায় ফিরে আসে কিন্তু আজ আর ফিরছে না। রাত আটটা বাজে এখনও বাড়ি ফেরেনি কবির। সেই সকালে জোনাকীকে বলে গিয়েছে আজ বেতন পেলে তার জন্যে সোনার নাকফুল আনবে। কিন্তু না, এখনও ফেরেনি। 
এদিকে কবিরের মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিশ্চয় কবিরের কোন বিপদ হয়েছে। তা না হলে এখনও কেন বাড়ি ফিরেনি। মায়ের মন ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে বউকে বললেন, এই অপায়া কইছিলাম না, মাইয়া মাইনসের নাকফুল হারাইলে সোয়ামীর অঙ্গল হয়। আজ যদি আমার পোলার কিছু হয় তোরে ছারুম না।
শাশুড়ির কথায় জোনাকীর কান্না আসে। রাত গভীর হলো। ঘরের এপাশ ওপাশ পায়চারি করে জোনাকী। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোথায় খুঁজবে স্বামীকে। জায়নামাজ হাতে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লো জোনাকী। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো, হে আল্লাহ আমার সোয়ামী যেখানেই থাকুক তুমি বালা রাইখ। আমার সোয়ামীকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিও। আমীন। ঘড়িতে দেখে রাত এগারটা বাজে। বিছানায় শুয়ে কবিরের কথাই ভাবতে থাকলো জোনাকী। কখনও যে ঘুমে ঢলে পড়লো তাও টের পেল না সে।
রাত বারোটা বাজে। হঠাৎ দরজায় নক করল। 
দরজার আওয়াজ পেয়ে জোনাকীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতো রাতে দরজায় নক করার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো ও। ভয়ে ভয়ে বললো, কেডা? 
আমি কবির। দরজা খোল। 
কবির নামটা শুনেই জোনাকীর যেন আত্মা ফিরে আসলো। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খোলে কবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আপনিতো কোন দিন এত রাইত করে বারিত ফিরেন নি। আজকা এমন হইল ক্যান? আপনার কিচ্ছু হয়নিতো?
Ñ না আমার কিচ্ছু হয়নি। সব কথা বলবো আমারে বসতে দাও। মা-বাবা কই, মা-বাবাকে ডাহ। 
জোকাকী তার শাশুড়িকে ডাকছে, আম্মা, ও আম্মা, আব্বা ও আব্বা দেখেন আপনার পুলা আইছে।
এত রাতে জোনাকীর ডাকে কবিরের মায়ের ঘুম ভাঙ্গে। কি কইলা আমার কবির আইছে। কই আমার কবির। বলেই দরজা খুলে দ্রুত কবিরের ঘরে চলে আসলো। কবিরের বাবা ও বোন তারাও ঘুম থেকে উঠে এ ঘরে চলে আসলো। কবিরের মা কবিরকে ঝাপটে ধরে বললো, কিরে বাপজান তোর কিছু হয়নিতো? 
- না মা আমার কিছু হয়নি?
- কই ছিলি এত রাইত পর্যন্ত?
- বেতন পাইয়া আমি গঞ্জের বাইনার দোকানে গিয়েছিলাম বউয়ের জন্য সোনার নাকফুল বানাইতে। সেইখান থেকে আসার পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হইছে। সে জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আজ ওখানে থাকতে বলছিল। আমি চলে আসছি তাই এত রাত হইয়া গেছে।
- আর আমি কি না কি ভাবছি। তোর বউকে আমি অনেক গাল মন্দ করেছি। 
- এসব কি বলছ তুমি মা! 
- হ্যাঁ আমি তোর বউকে অপয়া বলেছি।
কবির অশিক্ষিত হলেও কুসংস্কার একদম বিশ্বাস করে না। তার মা সবকিছুতেই কুসংস্কার খুঁজে পান। তাইতো নাকফুলকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে কবির মাকে বললো, মা তোকে বলি আর কোনদিন এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করবি না। এইসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না। 
কবিরের বাজান বললো, হ বাজান ঠিক কইছোস। তোর মা সারাজীবন এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে আমার পরিবারে অশান্তি করছে। তোর মারে বুঝাইয়া ক। 
কবিরের মা তখন নরম হয়ে বললো, আমি আর এসব বিশ্বাস করব না। এইসব বিশ্বাস কইরা আমার ফুলের মতো বউটারে গালমন্দ করছি। এই কথা বলেই জোনাকীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ও বউ তুমি আমারে মাপ করে দিও।
এ কথা শুনেই জোনাকী বলে উঠলো, ছি মা এসব কি কইতাছেন? আপনি আমার হরি। আপনি আমার মায়ের মতো। আপনারে আমি মাপ করুম কেমনে। আপনি আর এইসব বিশ্বাস না করলেই আমাগোর আর কোন সমস্যা হবে না। 
কবিরের মা বললো, ও কবির কই তোর বউয়ের সোনার নাকফুল দেখি।
কবির সোনার নাকফুল পকেট থেকে বের করে বললো, এই নে মা। তুই তোর পুলার বউরে নাকফুলটা পড়াইয়া দে। 
কবিরের মা নাকফুলটা হাতে নিয়ে বললো, অহো মা। তোমারে নাকফুল পড়াইয়া দেই। বলে জোনাকীর নাকে নাকফুলটি পড়িয়ে দিল। সবাই তখন খুশি হলো। 

তারিখ: ৩০/০১/২০১৭ইং

কোন মন্তব্য নেই: